Nazihar News Network
News from Nazihar It Solution

সুপ্রিম কোর্টের বিচারিক পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না

বিভিন্ন ইস্যুতে আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে মিছিল-সমাবেশ করে থাকেন। সম্প্রতি আদালতের এজলাসেও একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। এরপর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০০৫ সালে দেওয়া হাইকোর্টের একটি আদেশের কথা উল্লেখ করে বিরোধী দলবিএনপি-সমর্থকআইনজীবীদের মিছিল-সমাবেশ না করতে বলেছে। ২০০৫ সালে দুজন বিচারপতি আদালত প্রাঙ্গণে মিছিল–সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, আপনি তাঁদের একজন। সেই সময় বিরোধী দল আওয়ামী লীগ-সমর্থিত আইনজীবীরা তো আপনার সেই রায় অমান্য করে আদালতে মিছিল-সমাবেশ অব্যাহত রাখেন। কিন্তু এখন তাঁরা উল্টো অবস্থান নিয়েছেন। বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?

প্রথম আলো: বিভিন্ন ইস্যুতে আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে মিছিল-সমাবেশ করে থাকেন। সম্প্রতি আদালতের এজলাসেও একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। এরপর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০০৫ সালে দেওয়া হাইকোর্টের একটি আদেশের কথা উল্লেখ করে বিরোধী দলবিএনপি-সমর্থকআইনজীবীদের মিছিল-সমাবেশ না করতে বলেছে। ২০০৫ সালে দুজন বিচারপতি আদালত প্রাঙ্গণে মিছিল–সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, আপনি তাঁদের একজন। সেই সময় বিরোধী দল আওয়ামী লীগ-সমর্থিত আইনজীবীরা তো আপনার সেই রায় অমান্য করে আদালতে মিছিল-সমাবেশ অব্যাহত রাখেন। কিন্তু এখন তাঁরা উল্টো অবস্থান নিয়েছেন। বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?

এম এ মতিন: ২০০৫ সালের মামলাটি একটি সুয়োমোটো রুল। আদালত প্রাঙ্গণে মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে সবার প্রতি নিষেধজ্ঞা জারি করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ভারতে, বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্ট তাঁদের বিচারের পরিবেশ রক্ষার জন্য এই রকমের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। ২০০৫ সালে দেওয়া রায়ের রচয়িতা আমি বা অন্য কোনো বিচারক হলেও রায়টি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের। যেহেতু রায়টি চূড়ান্ত শুনানি হয়নি বা আপিল বিভাগ রায়টি বাতিল করেননি, তাই রায়ের আদেশটি সুপ্রিম কোর্টের আদেশ এবং সবার জন্য বাধ্যতামূলক। সুপ্রিম কোর্টের বিচারিক পরিবেশ রক্ষার্থে রায়টি তখন যেমন মেনে চলা উচিত ছিল, এখনো তা মেনে চলা উচিত বলে মনে করি।

প্রথম আলো: সম্প্রতি আপিল বিভাগের একজন বিচারক বলেছেন, তাঁরা ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’। আরেকজন বিচারক নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করেছেন। তাঁদের এ রকম বক্তব্যের পর বিরোধী দলের সমর্থক আইনজীবীরা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, বিচারকদের পদত্যাগ দাবি করেছেন। বিচারকদের এমন মন্তব্য ও আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

এম এ মতিন: যেকোনো বিচারক আদালতের বাইরে তাঁর নিজস্ব বক্তব্য দিতে পারেন। আইনজীবীরা বিক্ষুব্ধ হলে প্রতিক্রিয়াও দেখাতে পারেন। এসব বক্তব্য তাঁদের নিজস্ব এবং ব্যক্তিগত। সবার মতপ্রকাশের অধিকার সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত।

প্রথম আলো: বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। কিন্তু সম্প্রতি আইন কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সোনার হরিণ হয়েই থাকে’। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে এ রকম প্রশ্ন উঠছে কেন?

এম এ মতিন: ব্যাপারটা আপেক্ষিক এবং যাঁর যাঁর দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল। আইন কমিশন যদি এমনটি বলে থাকে, তাহলে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনার দাবি রাখে। বর্তমান বাস্তবতায় আইন কমিশন হয়তো তাদের মতামত ব্যক্ত করেছে। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের সৃষ্টি। সংবিধানে যদি অনুচ্ছেদ ১১৬ বলবৎ থাকে এবং অধস্তন আদালতগুলোর বিচারকদের পদোন্নতি, শৃঙ্খলা, পদায়ন, বদলি ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় সুপ্রিম কোর্টের ওপর না রেখে রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত রাখা হয়, তাহলে কোনো বিচারেই বিচার বিভাগকে স্বাধীন বলা যাবে না। হয়তোবা সে বিবেচনায় আইন কমিশন বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সোনার হরিণ বলেছে।

প্রথম আলো: আইন কমিশনের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৪২ লাখ। এই মামলাজটের প্রধান কারণ হিসেবে বিচারকের স্বল্পতার কথা বলা হয়েছে। এরই মধ্যে গত কয়েক বছরে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক ‘গায়েবি’ মামলা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ রকম চলতে থাকলে মামলাজট কমার কোনো সম্ভাবনা আছে কি?

এম এ মতিন: মামলা নিষ্পত্তির বিষয়টি শুধু বিচারকদের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে না। বিচারপতিদের কর্মক্ষমতার মান, সময়নিষ্ঠা এবং বিচারের পরিবেশও মামলা নিষ্পত্তির ব্যাপারে ভূমিকা রাখে। শুধু বিচারকদের সংখ্যা বাড়ালেই মামলার জট খুলবে না। ‘গায়েবি’ মামলা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইতিমধ্যে ব্লাস্ট (বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট) বনাম বাংলাদেশ মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ ফৌজদারি আইনের ৫৪ ধারা ও ১৬৭ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে রায় দিয়েছেন। রায়ে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার এবং রিমান্ডের বিধানগুলোর অপপ্রয়োগ না হয়। এ রায় অনুযায়ী, সব ফৌজদারি আইন যখনই সংবিধানের সঙ্গে যতটুকু সাংঘর্ষিক হবে, ততটুকু অসাংবিধানিক। আদালত চাইলে ‘গায়েবি’ মামলার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেন।

প্রথম আলো: বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রায়ই দাবি করা হচ্ছে, নির্বাহী বিভাগ বা সরকার বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ক্ষেত্রে তারা বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার প্রক্রিয়া নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন তুলেছে। বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার এই অভিযোগ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

এম এ মতিন: আগেই বলেছি, সংবিধানে যত দিন ১১৬ অনুচ্ছেদ বলবৎ থাকবে, তত দিন বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে পারে না। সংবিধান অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের কোনো বিভাগ অন্য বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বিচারপ্রক্রিয়া আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আইনের খেলাপ হলে আদালতই তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করবেন। আদালত যদি ভুল করেন, তার সমাধানও আদালতেই হতে হবে। কোনো আদালতই ত্রুটিমুক্ত নন। তবে প্রতিটি দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের রায় চূড়ান্ত হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এটা এ জন্য নয় যে সিদ্ধান্তটি ‘নির্ভুল’ বলেই ‘চূড়ান্ত’, বরং সিদ্ধান্ত বা প্রক্রিয়াটি ‘চূড়ান্ত’ বলেই সেটাকে ‘ত্রুটিমুক্ত’ বলে ধরে নিতে হবে।

প্রথম আলো: আদালতকে বলা হয় মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আদালতের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যে একটি হলো রাজনৈতিক বা দলীয় বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ। যদি কোনো বিচারক অতীতে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, বিচারকার্যে কি এর প্রভাব পড়তে পারে?

এম এ মতিন: রাজনৈতিক বিবেচনায় বা দলীয় বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ অন্য দেশেও হয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে যখন ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় আসে, তখন তাঁরা উদার বা প্রগতিশীল মানসিকতার আইনজীবীদের বিচারক নিয়োগ করেন। আবার রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় এলে তাঁরা রক্ষণশীলদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেন। সেই সব দেশে বিচারকেরা সাধারণত তাঁদের পেশাদারত্ব বজায় রাখেন। আমাদের দেশে বিচারকদের মধ্যে যাঁরা পূর্বে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, বিচারক হিসেবে শপথ নেওয়ার পরও তাঁদের কোনো কাজে সেই রাজনীতির প্রভাব থাকবে—এমনটা হওয়া উচিত নয়।

প্রথম আলো: বেশ কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। সেখানে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি বিচার বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নির্বাচনের সঙ্গে তো বিচার বিভাগের সরাসরি সম্পর্ক নেই। তবু বিচার বিভাগকে ভিসা নীতির সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হলো কেন?

এম এ মতিন: যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কাকে ভিসা দেবে, কাকে দেবে না, সেটা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের ওপর। তবে আমাদের বিচার বিভাগকে এই ভিসা নীতির অন্তর্ভুক্ত করাটা দুঃখজনক। আমাদের বিচার বিভাগ দেশের স্বার্থ ও সম্মান রক্ষা করবে এবং বিচারকেরা তাঁদের শপথ মেনে চলবেন—এটাই প্রত্যাশা করি।

Add comment

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.