ট্রাকচালক মামুনুর রশীদ যখন গাড়ি নিয়ে বের হতেন, তখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় স্ত্রী জেসমিন আক্তার ফোন করে খবর নিতেন। মহাসড়কে গাড়ি চালান মামুন। কিছু হয় কি না, এ নিয়ে সারাক্ষণই উদ্বেগে থাকতেন তাঁর স্ত্রী। অথচ ঘটে গেল এর উল্টোটাই।
এসব বলতে বলতে গলা ধরে আসে তাঁর। কান্নার সঙ্গে দলা পাকিয়ে আসা কয়েকটি শব্দ শোনা যায়। বলেন, ‘হায় আল্লাহ, আমি কী নিষ্ঠুর, কী করে তারে মাটিচাপা দিয়ে আসলাম।’
বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে তিনটায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার বানিয়ারছড়া এলাকায় লরি ও সিএনজি চালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হন মামুনুর রশীদের গর্ভবতী স্ত্রী জেসমিন আকতার ও শাশুড়ি রোকেয়া বেগম। মামুনের বাড়ি চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের ভান্ডারির ডেবা এলাকায়। বিয়ের এক বছরও হয়নি তাঁর। স্ত্রী জেসমিনের হাতের মেহেদিও রয়ে গেছে। কিন্তু অনাগত সন্তানকে নিয়ে স্ত্রী এভাবে চলে যাবেন, তা কোনোভাবেই মানতে পারছিলেন না মামুন।
চকরিয়ার ভান্ডারির ডেবা এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পূর্ব দিকে একটি পাহাড়ি ছড়া। ছড়ার ওপর সাঁকো পার হলেই টিনশেডের মাটির ঘর। সেই ঘরেই থাকতেন মামুনুর রশীদ আর জেসমিন আকতার দম্পতি। ঘরের সবকিছুই সাজানো-গোছানো। ছোট সংসারের নানা অনুষঙ্গ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেসবের দিকে তাকিয়ে বারবার ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন মামুন। বললেন, প্রথম সন্তান হবে বলে আগেই ঘরে ধাত্রী এনে রেখেছিলেন তিনি। ঘরভর্তি মানুষ। সবার চোখেমুখে আনন্দ। স্ত্রী জেসমিন আক্তারের প্রসববেদনা উঠলেও প্রসব হচ্ছিল না। দ্রুত একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ডেকে স্ত্রী, ধাত্রী, বাবা-মা আর শাশুড়িকে তুলে দেন। গুছিয়ে উঠে তিনি নিজেও যাবেন হাসপাতালে। দেখবেন সন্তানের মুখ, এমনই পরিকল্পনা। কিন্তু সেই ফুরসত পেলেন না। প্রায় ২৫ মিনিটও কাটেনি। এর মধ্যেই খবর এল, লরির সঙ্গে সংঘর্ষে বিধ্বস্ত হয়েছে অটোরিকশাটি। গর্ভবতী স্ত্রী ও শাশুড়ির লাশ মহাসড়কে পড়ে আছে। খবরটা শুনে পায়ের নিচের মাটি সরে গেল যেন। মনে হলো, সব শেষ।
শান্ত মাটির ঘরটিতে শোকের দমবন্ধ পরিবেশ। এর থেকে মামুনকে মুক্তি দিতেই কয়েকজন বন্ধু তাঁকে নিয়ে গেলেন পাশের একটি চা–দোকানে। সেখানে বসে মামুন বলেন, ‘দুজনে কত স্বপ্ন দেখেছি। ছেলে হলে আমি জিতব, আর মেয়ে হলে সে। দুজনের মধ্যে এমন কত খুনসুটি হতো। আজ সব শেষ।’
তরুণ মামুনুর রশীদ দেখতে সুদর্শন। পঁচিশের কোঠায় হবে বয়স। সুন্দর মুখটিতে বেদনার ছায়া পড়ে। কথা বলতে বলতে চুপ হয়ে যান। দীর্ঘক্ষণ পর বলে ওঠেন, ‘সে নিশ্চয় জানত আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। নইলে এত অল্প সময়ে মানুষ কীভাবে আরেকজনকে এত ভালোবাসতে পারে। দুজনের মধ্যে কখনো এক মিনিটের জন্যও মনোমালিন্য হয়নি। আশপাশের অনেকে এ নিয়ে হিংসা করত।’
মামুন বলেন, ‘যখন তাকে অটোরিকশায় তুলে দিই, তখন বলছিল, আমি যেন তাঁর সঙ্গে যাই। বাচ্চার প্রথম মুখ যেন তাঁর আগে আমি দেখি। কিন্তু বাচ্চার মুখ তো দেখিনি।
দেখেছি আমার ভালোবাসার মানুষের মরা মুখ। আমি সঙ্গে গেলে তো তার সঙ্গে চলে যেতে পারতাম, এমন কষ্ট সইতে হতো না।’
মামুনুর রশীদের বাবা দুদু মিয়া ও মা রাবেয়া বেগমও একই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরের ন্যাশনাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে তাঁদের অবস্থা সংকটমুক্ত বলে জানা গেছে।







Add comment