Nazihar News Network
News from Nazihar It Solution Limited

পুতিনের আশার গুড়ে বালি দিলেন সি চিন পিং

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের তিন দিনের রাশিয়া সফর খানাপিনা, ফটোসেশন, চুক্তি স্বাক্ষরসহ নানা আয়োজনে ঠাসা ছিল। এই সব আনুষ্ঠানিকতা একপাশে সরিয়ে রাখলে দেখা যাচ্ছে, সি চিন পিংয়ের এই সফরে পুতিনের আশা ও প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের তিন দিনের রাশিয়া সফর খানাপিনা, ফটোসেশন, চুক্তি স্বাক্ষরসহ নানা আয়োজনে ঠাসা ছিল। এই সব আনুষ্ঠানিকতা একপাশে সরিয়ে রাখলে দেখা যাচ্ছে, সি চিন পিংয়ের এই সফরে পুতিনের আশা ও প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।

ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার স্বৈরতান্ত্রিক কায়দা এবং পশ্চিমের সঙ্গে ভঙ্গুর সম্পর্ক—দুই নেতার মধ্যে এই দুই মিল থাকা সত্ত্বেও, এ সফরে তাঁদের যৌথ স্বার্থ ও উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়নি। সি চিন মস্কো এলেন ও চলে গেলেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি দিলেন না। পুতিন ও তাঁর সহচরদের আশার গুড়ে শুধু বালিই জমা হলো।

রাশিয়া চীনকে কীভাবে দেখে? মস্কোর দৃষ্টিতে চীন বিশ্বে একমাত্র বড় শক্তি, যারা ইউক্রেন আগ্রাসনের নিন্দা জানায়নি, অর্থনৈতিক দিক থেকে তাদের ঘনিষ্ঠ  বন্ধু, অস্ত্র সরবরাহকারী ও ‘শান্তির’ পরামর্শক। ইউক্রেন আগ্রাসনের একেবারে শুরুর দিন থেকে রাশিয়ার বুদ্ধিজীবী ও প্রভাবশালী বিশ্লেষকেরা বলতে শুরু করেন, এই যুদ্ধে রাশিয়াকে বিজয়ী করার ক্ষেত্রে প্রধানভাবে সহায়তা করতে পারে চীন। পশ্চিমাদের কাছ থেকে বড় ধরনের বিনিয়োগ হারানোয় এখন রাশিয়াকে প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে এবং মস্কোর দেওয়া শর্ত অনুযায়ী শান্তি স্থাপনে সহযোগিতা করবে চীন। কিন্তু রুশদের এই হিসাব–নিকাশ থেকে একটা জিনিস সব সময় বাদ পড়ে যায়।

কোভিড মহামারি–পরবর্তী নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতায় চীন অনিবার্য নয়। কিন্তু ভবিষ্যৎ বিচ্ছেদের আগপর্যন্ত চীনের অর্থনৈতিক ভূমিকা থেকেই যাবে। পুতিনের ভুল প্রত্যাশায় নিজেকে বাজি ধরার কোনো পরিকল্পনা সি চিনের নেই। রাশিয়ার তেল কম দামে কিনেই খুশি থাকবেন সি চিন পিং।

রাশিয়া-চীন যৌথ সম্পর্কের লাভ ও উদ্দেশ্য নিয়ে অনেক বাগাড়ম্বর থাকা সত্ত্বেও বাস্তবতা হলো, চীনকে দেওয়ার মতো সামান্য কিছু আছে রাশিয়ার হাতে। পশ্চিমা বিশ্ব নতুন বাজার থেকে জ্বালানি আমদানি করায় অনেকটা সাগ্রহেই রাশিয়ার তেল ও গ্যাস কিনছে চীন। ফলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে চীন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। রাশিয়া চীনের জন্য তার বাজার উন্মুক্ত করে দিলেও ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় রাশিয়ার বাজার বামনাকৃতির। রাশিয়া চীনের কাছ থেকে অনেক কিছু চাইছে, কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কে পুরোপুরি সুবিধাটা চীনই আদায় করে নিতে পারছে।

প্রকৃতপক্ষে সি চিন পিংয়ের মস্কো সফরে রাশিয়ার প্রাপ্তি সামান্যই। বরং এই সফর পশ্চিমাদের উদ্দেশে বার্তা দিতে চেয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট। দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে। চীনের সেমিকন্ডাক্টর শিল্প ও অন্যান্য হাইটেক পণ্য আমদানিতে একগাদা বিধিনিষেধও দিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে সি চিন পিং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ‘ঘনিষ্ঠ’ করে পশ্চিমাদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করতে চাইছেন।

তাইওয়ানকে রক্ষার জন্য চীনের একেবারে নাকের ডগায় পশ্চিমারা সামরিক শক্তি প্রদর্শন করছে। পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করছেন, এমনটা দেখিয়ে পশ্চিমাদের সেখান থেকে সরিয়ে আনার প্রত্যাশা করছেন সি চিন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ওঠার ঠিক এক দিন পর সি চিন তাঁর মস্কো সফরের সময়সূচি ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে সি চিন পিং পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের আইনি সংস্থার দিকে মোটামুটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন।  প্রকৃতপক্ষে রুশ নেতার সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার হুমকি দিয়ে পশ্চিমাদের কাছ থেকে ছাড় আদায় করে নিতে চাইছেন সি চিন।

একটা বিষয় হলো, শক্তিশালী অবস্থান থেকে সি চিন পিং পশ্চিমাদের সঙ্গে দর–কষাকষি করতে নামেননি। শূন্য কোভিড নীতি এবং আবাসন খাতের সংকটের কারণে চীনের অর্থনীতি তিন বছর ধরে সংকটের আবর্তে ঘুরছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যের ওপর চীনের অর্থনীতি বহুলাংশে নির্ভরশীল। চীনের রাজকোষের বিশাল একটা অংশ আসে ডলার ও ইউরো থেকে। সি চিন পিং এতটা বোকা নন যে রাশিয়ার অর্থনীতি আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে পুতিনকে নিশ্চয়তা দেবেন।

নিষেধাজ্ঞার ফলে এক বছর ধরে রাশিয়ার অর্থনীতিতে কতটা ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে, তা খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে চীন। সি চিন এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন যে পশ্চিমা বিশ্বকে খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসলে তার অর্থনৈতিক পরিণাম কতটা ভয়াবহ হতে পারে। অগণতান্ত্রিক দেশের শাসকেরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন না, সে কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তাদের টিকে থাকার একমাত্র রাজনৈতিক কৌশল। পুতিনকে সহযোগিতা করে সি চিন পিং তাঁর নিজের মসনদকে বিপদে ফেলবেন না।

ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন পশ্চিমা বিশ্বে একটি উপলব্ধি বন্যার পানির মতো বেড়ে চলেছে। সেটি হলো, নিপীড়ক শাসকদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আলগা করার সময় হয়েছে। অর্থাৎ কম দামের ইলেকট্রনিকস পণ্য এবং সস্তা মানের পোশাক কেনার চল থেকে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে। পশ্চিমা ভোক্তারা ভালো মানের পণ্য চাইছেন, তাঁরা চাইছেন এসব পণ্য যেন ভালো উৎস থেকে কেনা হয়। এ ছাড়া পশ্চিমা ক্রেতারা আরও সস্তায় পণ্য কেনার উৎস খুঁজে পাচ্ছেন। বাজারের এই হাওয়া চীনের দিকে ঘোরাতেই রাশিয়ার সঙ্গে সি চিন পিং সম্প্রীতির ভান দেখাচ্ছেন।

এই টোপ গেলা পশ্চিমের জন্য ঠিক হবে না। কোভিড মহামারি–পরবর্তী নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতায় চীন অনিবার্য নয়। কিন্তু ভবিষ্যৎ বিচ্ছেদের আগপর্যন্ত চীনের অর্থনৈতিক ভূমিকা থেকেই যাবে। পুতিনের ভুল প্রত্যাশায় নিজেকে বাজি ধরার কোনো পরিকল্পনা সি চিনের নেই। রাশিয়ার তেল কম দামে কিনেই খুশি থাকবেন সি চিন পিং। তিনি আনন্দের সঙ্গে রাশিয়ার অকার্যকর বাজার চীনের সস্তা ইলেকট্রনিক পণ্য ও সস্তা পোশাক এবং মোটরগাড়িতে ভরিয়ে দিতে রাজি থাকবেন। রাশিয়াকে চেপে রস নিংড়ে ছিবড়ে বানাবেন, কিন্তু যখন সময় ও সুযোগ আসবে, তখন নতুন বন্ধুকে পরিত্যাগ করতে দ্বিধা করবেন না।

দ্য গর্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • ওলগা চাইজ টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক

Add comment

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.