রোজা সামনে রেখে সরকার চিনি আমদানিতে শুল্কছাড় দিয়েছিল। কিন্তু রোজা আসার পর শুল্কছাড়ের কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না বাজারে। উল্টো শুল্ক কমানোর পর সরকারি হিসাবে চিনির দাম আরও ২ শতাংশ বেড়েছে। সরকার গত ৭ মাসে চিনির দাম চারবার বেঁধে দিয়েও বাজারের লাগাম টানতে পারেনি। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে শেষমেশ শুল্ক কমায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এত কিছুর পরও সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না।
কয়েক দিন আগে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী আশা প্রকাশ করেছেন যে রোজার মধ্যে চিনির দাম কেজিতে ৫ টাকা কমতে পারে। গতকাল শুক্রবার রোজা শুরু হয়ে গেছে। এখন অপেক্ষার পালা, চিনির দাম কবে কমবে?
রাজধানীর মৌলভীবাজারে গত বৃহস্পতিবার ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা খোলা চিনি পাইকারিতে ৫ হাজার ৪০০ টাকার কমবেশিতে বিক্রি হয়েছে। এতে প্রতি কেজি চিনির পাইকারি দাম পড়ে ১০৮ টাকা। অথচ সরকারিভাবে খোলা এই চিনির খুচরা দাম বেঁধে দেওয়া আছে ১০৭ টাকা। অর্থাৎ পাইকারি বাজারেই সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে। সরকার প্যাকেটজাত চিনির খুচরা মূল্য নির্ধারণ করেছে প্রতি কেজি ১১২ টাকা। কিন্তু এই দাম তো পরের বিষয়, বাজারে প্যাকেটজাত চিনি মিলছেই খুব কম। অবশ্য এখন খোলা চিনির সংকট নেই। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা ও প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি হচ্ছে কমবেশি ১২০ টাকায়।
এতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি, মিল থেকে দাম বাড়তি রাখা হচ্ছে না। সরবরাহেও কোনো সমস্যা নেই। এর পরও বাড়তি দামে চিনি বিক্রি হলে পাইকারি ও খুচরা বাজারে সরকারের পক্ষ থেকে তদারকি বাড়াতে হবে।
গোলাম রহমান, মহাসচিব, সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন
রাজধানীর সেগুনবাগিচা বাজারের আল্লাহর দান স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. শিপন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাইকারি বাজারে চিনির দাম এখনো বেশি। এর সঙ্গে পরিবহন খরচ ও শ্রমিকের মজুরি আছে। তাতে চিনি সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশিতেই দোকানে ওঠাতে হয়। তাই আমাদের খুচরা বিক্রিতে লাভ করতে গেলে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।’
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাজারে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশিতে বিক্রি হচ্ছে চিনি। অর্থাৎ সরকার দাম বেঁধে দেওয়ার পাশাপাশি শুল্ক কমালেও বাজারে চিনির দাম আরেক দফা বেড়েছে। শুল্ক কমানোর পরে চিনির দাম ২ শতাংশের বেশি বেড়েছে। টিসিবির হিসাবেই বাজারে এখন প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়।
রাজধানীর মৌলভীবাজারের পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, ‘শুল্ক কমানোর আগে আমরা যে দামে চিনি মিল ফটক থেকে পেতাম, এখনো সেই দামেই পাচ্ছি। শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত আসার পর ১০ দিন অতিবাহিত হলেও চিনির দামে কোনো পরিবর্তন নেই।’
তবে মিল ফটক থেকে সরকারের বেঁধে দেওয়া পাইকারি দামেই চিনি বিক্রি হচ্ছে উল্লেখ করে সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি, মিল থেকে দাম বাড়তি রাখা হচ্ছে না। সরবরাহেও কোনো সমস্যা নেই। এর পরও বাড়তি দামে চিনি বিক্রি হলে পাইকারি ও খুচরা বাজারে সরকারের পক্ষ থেকে তদারকি বাড়াতে হবে।’ অবশ্য শুল্ক কমার প্রভাব বাজারে পড়তে আরও কিছুটা সময় লাগবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শুল্ক কমার প্রভাব বাজারে কখন পড়বে তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি মিলমালিকদের প্রতিনিধিরা। তাঁরা বলছেন, চিনির বাজার যখন একটু একটু করে বাড়তে শুরু করেছিল, তখনই সরকারকে চিনি আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ক কাঠামো সংস্কারের অনুরোধ করা হয়। সরকার বিষয়টি সেই সময় আমলে নিলে বাজার এতটা চড়ত না। রোজা সামনে রেখে যখন সরকার শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিল, তখন বাজারে প্রভাব পড়ার মতো পরিস্থিতি নেই। তাঁরা বলেন, চিনি আমদানিতে দুই মাসের বেশি সময় লেগে যায়। নতুন চিনি না এলে বাজারে শুল্ক কমার প্রভাব পড়বে না।
গত ১৯ মার্চ সচিবালয়ে ‘দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের ষষ্ঠ সভা’ শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, চিনির দাম কেজিতে পাঁচ টাকা কমাতে রাজি হয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চিনি আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করেছে। একই সঙ্গে প্রতি টন অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে তিন হাজার টাকা এবং পরিশোধিত চিনিতে ছয় হাজার টাকা আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। এই সুবিধা আগামী ৩০ মে পর্যন্ত বহাল থাকবে। এই শুল্ক কাঠামোর মধ্যে আমদানি হওয়া প্রতি কেজি চিনিতে ৫ টাকা দাম কমতে পারে বলে ধারণা ব্যবসায়ীদের। অর্থাৎ এত কিছুর পরও খুব শিগগির প্রতি কেজি চিনি ১০০ টাকার নিচে নামার লক্ষণ নেই।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী গত বছর এ সময়ে বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। সেই হিসাবে গত এক বছরে চিনির দাম ৫০ শতাংশের মতো বেড়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু রোজার মাসেই চাহিদা থাকে তিন লাখ টনের। অথচ দেশের সরকারি চিনিকলগুলোতে সব মিলিয়ে উৎপাদন হয় মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টন।







Add comment