নতুন শিক্ষাক্রমে পড়াশোনার যে পদ্ধতি, তাতে নোট, গাইড বা এ ধরনের সহায়ক বইয়ের প্রয়োজন পড়বে না। কোচিং না করলেও চলবে, এমন একটি ধারণা দিয়ে আসছেন শিক্ষার নীতিনির্ধারকেরা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নতুন এই শিক্ষাক্রম ঠিকমতো শুরু হতে না হতেই বাজার ভরে গেছে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি ‘সহায়ক বই’ নামের গাইড বই দিয়ে। ‘একের ভেতর সব’ নাম দিয়ে তৈরি এসব গাইড এখন বিক্রিও হচ্ছে বেশ।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা জানিয়েছেন, উদ্বুদ্ধ করতে কোনো কোনো প্রকাশনীর পক্ষ থেকে এসব গাইড বই তাঁদের প্রতিষ্ঠানেও দিয়ে যাচ্ছে।
নীলক্ষেতে একাধিক বইয়ের দোকান এবং ঢাকার সুপরিচিত একটি বিদ্যালয়সংলগ্ন একই বইয়ের দোকানে সরেজমিনে দেখা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত এসব ‘সহায়ক বই’ পাওয়া যাচ্ছে।
এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে এসব সহায়ক বইয়ের প্রয়োজন নেই। তাঁরাও কাউকে সহায়ক বই বিক্রির অনুমোদন দেননি, সুযোগও নেই। যাঁরা এটি করছেন, তাঁরা বেআইনি কাজ করছেন।
গত ১ জানুয়ারি থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। আগামী বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হবে। একইভাবে ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে তা বাস্তবায়িত হবে। এরপর উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যবই বদলে যাচ্ছে। মূল্যায়নেও আসছে বড় পরিবর্তন। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে (শিখনকালীন) বড় অংশের মূল্যায়ন হবে। কিছু অংশের মূল্যায়ন হবে সামষ্টিকভাবে বা পরীক্ষার মাধ্যমে। তবে, এখনকার মতো প্রথাগত পরীক্ষা হবে না।

অবশ্য, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই নতুন শিক্ষাক্রম শুরু করতে গিয়ে বেশ কিছু অসুবিধার মুখে পড়েছে শিক্ষা বিভাগ। বিতর্কের মুখে গত ১০ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ পাঠ্যপুস্তক দুটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলনী পাঠ’এবং ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়েরও কিছু অধ্যায় সংশোধন করা হচ্ছে। যদিও কাজটি এখনো শেষ করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংস্থা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা অসুবিধায় পড়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রমটি প্রণয়ন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংস্থা এনসিটিবি। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কাজটি দেখভাল করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।
নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে এখনই বাজার নোট-গাইডে সয়লাব হয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন গতকাল বৃহস্পতিবার নিজ কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো অভিযোগ পাননি। অভিযোগ পেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেবেন।
সরেজমিন চিত্র
মাউশির পরিচালকের কাছে এ নিয়ে কেউ অভিযোগ না করলেও সরেজমিনে ঠিকই পাওয়া গেছে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি গাইড বই। গত বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর বেইলি রোডে অবস্থিত ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল ক্যাম্পাসসংলগ্ন থিয়েটার কর্নার নামে একটি বই-খাতার দোকানে গিয়ে পাওয়া গেল ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত নতুন শিক্ষাক্রমের গাইড বই। অবশ্য বইয়ের গায়ে ‘গাইড বই’ লেখা নেই, লেখা আছে ‘সহায়ক বই’। দোকানির কাছে ষষ্ঠ শ্রেণির গাইড বই চাইলে একটি বেসরকারি প্রকাশনীর এক সেট বই দেন। বইয়ের গায়ে বড় করে লেখা আছে ‘একের ভেতর সব’। তাতে পাঁচটি সহায়ক বই একসঙ্গে বাঁধাই করা। পাঁচ খণ্ডের এক সেট বইয়ের দাম গায়ে লেখা আছে ১ হাজার ২০০ টাকা। কত টাকায় বিক্রি করতে পারবেন, সে কথা জানতে চাইলে দোকানি হিসাব করে ১ হাজার ১৪০ টাকায় দিতে চাইলেন।
একই দিনে দুপুরের পরে বইয়ের বাজার হিসেবে পরিচিত নীলক্ষেতে গিয়েও পাওয়া গেল ওই দুই শ্রেণির গাইড বই। সেখানকার একটি দোকানে সপ্তম শ্রেণির গাইড বই চাইলে দোকানি এক সেট বই বের করে দেন। তাতে ছয় খণ্ডে (ছয়টি বই) একত্রে সপ্তম শ্রেণির এসব ‘সহায়ক বই’ বইয়ের গায়ের দাম লেখা আছে ১ হাজার ১৮০ টাকা। তবে, দরদাম করলে দোকানি এক হাজার টাকায় তা দিতে চাইলেন। তবে অন্য আরেকটি দোকানে গেলে আরেকটি প্রকাশনীর বইয়ের দাম আরও বেশি চান দোকানি।
১৯৮০ সালে করা একটি আইনে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নোট-গাইড নিষিদ্ধ আছে। এ জন্য এখন প্রকাশনী সংস্থাগুলো নোট-গাইডের পরিবর্তে ‘অনুশীলন বই’ বা ‘সহায়ক পাঠ্যবই’ নামে কার্যত গাইড বই বিক্রি করে থাকে বলে অভিযোগ আছে। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খসড়ায়ও নোট–গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধই রাখা হয়েছে। তবে প্রস্তাবিত এই আইনে সরকারের অনুমোদন নিয়ে সহায়ক বই বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করার সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সহায়ক বই কেনা বা পাঠে বাধ্য করতে পারবেন না। এসব বই কিনতে বা পাঠে বাধ্য করলে বা উৎসাহ দিলে তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে।
তবে, প্রস্তাবিত এই শিক্ষা আইন এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সরকারের বাকি মেয়াদে হবে কি না, সেটিও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। এর মানে হলো, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, এখন অবধি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নোট-গাইড নিষিদ্ধ।
এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে এসব সহায়ক বইয়ের প্রয়োজন নেই। তাঁরাও কাউকে সহায়ক বই বিক্রির অনুমোদন দেননি, সুযোগও নেই। যাঁরা এটি করছেন, তাঁরা বেআইনি কাজ করছেন।
রাজধানীর একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জানান, নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নোটবইয়ে বাজার সয়লাব। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসে নোটবই দিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আরও আগে নজর দেওয়া এবং কঠোর হওয়া উচিত ছিল। এইভাবে চলতে থাকলে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে উঠবে।
Add comment