ইসলামি দল সরকারবিরোধী অবস্থানে রয়েছে, তাদের নিরপেক্ষ অবস্থানে আনার কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
ধর্মভিত্তিক ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে নানামুখী কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সরকারের সঙ্গে নেই—এমন ইসলামি দলগুলো যাতে বিরোধী দল বিএনপির আন্দোলনে ভিড়ে না যায়, সেই চেষ্টা রয়েছে আওয়ামী লীগের। অনেক ইসলামি দলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির তৎপরতাও রয়েছে। এমনকি কিছু ইসলামি দলকে সরকার থেকে বিভিন্ন চাপেও রাখা হচ্ছে। ইসলামি কিছু দল দিয়ে প্রয়োজনে একটি মোর্চা দাঁড় করানোর চিন্তাও রয়েছে বলে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন ইসলামি দলের ওপর কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের একটা প্রভাব রয়েছে। এই হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সরকারের যে সখ্য তৈরি হয়েছিল, এখন সংগঠনটির ওপর সরকারের একধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে ইসলামি দলের বিভিন্ন নেতা মনে করেন।
আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা বলেন, ভোটের রাজনীতিতে ইসলামি দলগুলোর একধরনের প্রভাব রয়েছে। সে জন্য জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ইসলামি দলগুলোকে সঙ্গে রাখার চেষ্টা করছে। যেসব ইসলামি দল সরকারবিরোধী অবস্থানে রয়েছে, তাদের নিরপেক্ষ অবস্থানে আনার কৌশল তাঁরা নিয়েছেন।
তবে ইসলামি দলগুলো এবং হেফাজতে ইসলামের প্রতি আওয়ামী লীগের বাড়তি কদর নিয়ে সমালোচনা রয়েছে ১৪–দলীয় জোটের অন্য শরিকদের। এই জোটে আওয়ামী লীগের অন্য শরিকদের অভিযোগ হচ্ছে, এ ধরনের মনোভাবের কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে ইসলামি দল বা সংগঠনগুলো বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে থাকে এবং সরকারকে অনেক ছাড় দিতে হচ্ছে। সে জন্য ধর্মীয় সংঘাতেও অনেক ক্ষেত্রে সরকার কঠোর হতে পারছে না।
এমন অভিযোগের ব্যাপারে ১৪ দলে আওয়ামী লীগের শরিকেরা সর্বশেষ পঞ্চগড়ে আহমদিয়া জামাতের একই ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সংঘাতে হতাহতের ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন।
আগামী নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে। এ ক্ষেত্রে কোন দল কার সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করবে, তা আরও পরে স্পষ্ট হবে।
আসাদুজ্জামান খান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
সম্প্রতি চারমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন ইসলামি দল ও সংগঠনের আপত্তির মুখে সম্প্রতি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি পাঠ্যবই প্রত্যাহার করা হয়। এর আগেও পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে।
আওয়ামী লীগ এবং সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ছাড় দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। কিন্তু সংগঠনের নেতাদের মুক্তির দাবি এবং ধর্মীয় নানা বিষয়ে বিভিন্ন সময় হেফাজত ইসলাম এবং ইসলামি অনেক দলের নেতাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলোচনা বা সমঝোতা বৈঠক করতে দেখা গেছে।
অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সঙ্গে বিএনপি, ধর্মভিত্তিক দল—সবারই বৈঠক হয়। এর সঙ্গে জোট কিংবা অন্য বিষয় নেই। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে বলে তিনি মনে করেন। এ ক্ষেত্রে কোন দল কার সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করবে, তা আরও পরে স্পষ্ট হবে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, ধর্মভিত্তিক ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। তবে হেফাজতে ইসলামসংক্রান্ত এবং কিছু ইসলামি দলের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়। স্থানীয়ভাবে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদও যোগাযোগ রক্ষা করেন। ২ জুন ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চরমোনাই পীরের ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের জাতীয় সম্মেলনে উপস্থিত থেকে হাছান মাহমুদ বক্তৃতা করেন। অবশ্য ওই সম্মেলন মঞ্চে বিএনপিরও একজন নেতা উপস্থিত ছিলেন।
এর বাইরে সরকারের নানা প্রতিষ্ঠানও ধর্মভিত্তিক দলগুলোর বিষয়ে খোঁজখবর রাখে। ১৪ দলের জোটে অন্তর্ভুক্তির বিষয় এলে জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু তাতে ভূমিকা রাখেন।
সর্বশেষ গত ৮ ডিসেম্বর ইস্কাটনে ১৪ দলের এক বৈঠকে আমির হোসেন আমু ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ নামের একটি দলকে জোটে নেওয়া যায় কি না, সেই প্রস্তাব তুলেছিলেন। কিন্তু অন্য শরিকদের আপত্তিতে তা আর এগোয়নি। ইসলামিক ফ্রন্ট নামের এই দলটি প্রকাশ্যে সরকারের সমর্থনে বক্তব্য–বিবৃতি দিয়ে থাকে। এই দলটির আগ্রহের কারণেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১৪–দলীয় জোটে নেওয়ার প্রস্তাব তোলা হয়েছিল।
জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বড় শক্তি
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের কোনো সমঝোতার সম্ভাবনা দেখছেন না দলটির নেতারা। আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, জামায়াতের প্রতি নমনীয়তা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর আওয়ামী লীগ সরকারকে নিয়ে জামায়াতে ইসলামীতে তিক্ততা রয়েছে। কারণ, আওয়ামী লিগ সরকারের সময় যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিএনপির প্রতি জামায়াতের একধরনের অভিমান, এমনকি ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। সেটাকে ভোটের রাজনীতিতে একটা সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চায় আওয়ামী লীগ।
সরকার ও আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, বিএনপি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে জামায়াতকে ভোটে রাখার চেষ্টা করবে সরকার। আর বিএনপি ভোটে এলে তখনো জামায়াতকে ব্যবহার করা যায় কি না, এ নিয়েও আওয়ামী লীগ ভাবছে।
তবে লম্বা সময় ধরে সরকারের চাপ এবং বাধার কারণে জামায়ত প্রকাশ্যে সেভাবে কর্মকাণ্ড চালাতে পারছে না। সেখানে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন একটা অবস্থান তৈরি করছে। ফলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি তাদের পাশে চাইছে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে চরমোনাই পীরের বার্ষিক মাহফিলে কেন্দ্রীয় নেতাসহ বিএনপির ১০ সদস্যের প্রতিনিধি গিয়ে বৈঠকও করেছেন।
আওয়ামী লীগ ও সরকারের সূত্র বলছে, চরমোনাই পীরের দল বরাবরই মধ্যপন্থা অবলম্বন করে থাকে। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগটা একটু নিবিড়। সরকার ও আওয়ামী লীগ নিয়মিতই দলটির নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে। বিএনপির দৌড়ঝাঁপ বৃদ্ধির পর ইসলামী আন্দোলনের প্রতি সরকারের নজর আরও বেড়েছে।
ইসলামী আন্দোলন আওয়ামী লীগের সঙ্গে না এলেও বিএনপির সঙ্গে যেতে পারবে না বলে মনে করছেন সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, চরমোনাই পীরের দলকে দিয়ে ধর্মভিত্তিক আরও কিছু দল নিয়ে তৃতীয় কোনো মোর্চা করার ইচ্ছা আছে সরকারের। এ ক্ষেত্রে বিএনপি আগামী নির্বাচন বর্জন করলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাদের জন্য বড় ধরনের ছাড় দেওয়া হতে পারে।
ইসলামী আন্দোলনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আশরাফ আলী আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি দল বিপরীতমুখী অবস্থানে। ইসলামী আন্দোলন মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছে। সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন—এই ফর্মুলায় তাঁরা একটি জোট করার আলোচনা চালাচ্ছেন। এতে ধর্মভিত্তিক দলের বাইরের দলও থাকবে।
অন্য ধর্মভিত্তিক দল শক্তি হারিয়েছে
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ধর্মভিত্তিক ইসলামি দল ১০টি। এর মধ্যে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দল আছে ৬টি। সেগুলো হলো ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে সরকারের অভিযানের পর সংগঠনটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এরপর সরকার তাদেরকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পাশে রাখার চেষ্টা করেছে। আবার ভেতরে-ভেতরে উপদলীয় কোন্দল সৃষ্টি করে দুর্বল করেছে। এই পরিস্থিতিতে হেফাজতের নেতাদের নেতৃত্বাধীন ধর্মভিত্তিক দলগুলোর এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। এ সুযোগটাই নিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও সরকার।
প্রয়াত মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট অনেকটাই শক্তি হারিয়েছে। আমিনীর ছেলে হাসনাত আমিনীর সঙ্গে সরকার যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। তাঁদেরকে আসন ছাড় দিয়ে ভোটে আনার প্রস্তাবও আছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। ইসলামী ঐক্যজোট আওয়ামী লীগের প্রস্তাব গ্রহণ না করলেও প্রত্যাখ্যান করেনি। তারা সময় নিতে চাইছে। আতাউল্লাহ হাফেজ্জির খেলাফত আন্দোলন সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে চলছে।
প্রয়াত শায়খুল হাদিস প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক কারাগারে। এ অবস্থায় তাদের সরকারের বাইরে যাওয়ার সুযোগ কম বলে আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন।
জাকের পার্টি বরাবরই আওয়ামী লীগের সঙ্গে রয়েছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে মহাজোট গঠিত হয়, তাতে অন্যতম শরিক ছিল জাকের পার্টি।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও ১৪ দলের অন্যতম নেতা রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, ১৪ দলে ধর্মভিত্তিক দলের অন্তর্ভুক্তির বিপক্ষে তাঁরা। ভোটে বৃহত্তর ঐক্য হতে পারে। তবে তাঁর পরামর্শ হচ্ছে সরকারের ওপর ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনের প্রভাব বেড়েছে। এটা কমানো উচিত।







Add comment