জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) অথবা জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে নিবন্ধনের মাধ্যমে ট্রেনের টিকিট কাটার নিয়ম চালু করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। গতকাল বুধবার থেকে নতুন এ পদ্ধতিতে অনলাইন ও কাউন্টারে ট্রেনের টিকিট বিক্রি হচ্ছে। রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, টিকিট কালোবাজারি বন্ধ করতে ও স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে টিকিট সংগ্রহের নতুন এই পদ্ধতি কার্যকর হবে।
তবে দিনাজপুর রেলস্টেশনে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন বলছেন, কত দিন পর্যন্ত নতুন এই পদ্ধতি চালু থাকবে, সেটা দেখার বিষয়। তাঁদের দাবি, নিয়ম করে টিকিট কালোবাজারি বন্ধ করা যাবে না। কারণ, যাত্রীদের মধ্যে সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে চান না। দিন শেষে কেউ না কেউ টিকিটের জন্য তাঁদের ওপরই ভরসা করবেন। আর ভরসা করা মানেই তাঁদের জন্য আয়ের পথ খোলা থাকবে।
একটা আইডি কার্ড দিয়ে টিকিট কাটা যাবে চারটা। চারজন যাত্রীর কাছে যখন চারটা টিকিট বিক্রি করব, তখন তাঁরা ট্রেনে নিজেদের একে অন্যের আত্মীয় পরিচয় দেবে। তাহলেই হিসাব খালাস।
টিকিট কালোবাজারি
গতকাল বুধবার বিকেলে দিনাজপুর রেলস্টেশন চত্বরে এমন তিন ব্যক্তির সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। কাউন্টার অথবা অনলাইনে টিকিট না পাওয়া যাত্রীদের বিভিন্ন সময়ে টিকিটের ব্যবস্থা করে দেন তাঁরা। বিনিময়ে টিকিটের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে দ্বিগুণ; পরিস্থিতি বিবেচনায় কখনও তাঁরা তিন গুণ অর্থও নিয়ে থাকেন। দিনাজপুর রেলস্টেশনে টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে অন্তত ৪৫ থেকে ৫০ জন যুক্ত আছেন বলে জানালেন তাঁরা। দিনাজপুর ছাড়াও সেতাবগঞ্জ, পার্বতীপুর ও ফুলবাড়ীতেও তাঁদের ‘নেটওয়ার্ক’ আছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে কালোবাজারিদের মধ্যে একজন (৪২) বলেন, ‘সকাল থেকে কাউন্টারের আশপাশে ছিলাম। দেখলাম, যাত্রীদের সঙ্গে ভালো-মন্দ কথা বললাম। হঠাৎ করে অনেক মানুষ এই ধরনের নিয়মের মাধ্যমে টিকিট কাটতে পারেননি। অনেকেই ঘুরে গেছেন। পরবর্তী সময়ে ব্যবসাটা কীভাবে চলবে, সেটাও চিন্তা করলাম আরকি।’
স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পাওয়া গেল আরেক কালোবাজারিকে (৫০)। এর মধ্যেই এক যাত্রী কালোবাজারিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘কি ভাই, ঢাকার টিকিট হবে নাকি?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘না ভাই ওইদিন আর নাই। স্যারেরা নতুন নিয়ম বাইর করি ফেলাইচে।’ আলাপে অংশ নিতে প্রতিবেদক ওই কালোবাজারিকে প্রশ্ন করলেন—‘আপনারা এখন কী করবেন?’ অনেকটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে জবাব দিলেন ওই কালোবাজারি। তিনি বলেন, ‘ধরেন, আপনি ঢাকা যাবেন। আছেন পঞ্চগড়ে। অনলাইনে টিকিট কাটতে পারেননি। তখন আপনি কী করবেন? এখন ধরেন, একটা আইডি কার্ড (জাতীয় পরিচয়পত্র) দিয়ে টিকিট কাটা যাবে চারটা। চারজন যাত্রীর কাছে যখন চারটা টিকিট বিক্রি করব, তখন তাঁরা ট্রেনে নিজেদের একে অন্যের আত্মীয় পরিচয় দেবে। তাহলেই হিসাব খালাস।’
স্টেশন এলাকার একটি চায়ের দোকানে আরেক কালোবাজারির সঙ্গে আলাপ হলো। তিনিও আশা করছেন, তাঁদের এই ব্যবসা একবারে বন্ধ হয়ে যাবে না। ওই ব্যক্তি বলেন, ‘নিজের একটা আইডি কার্ড (জাতীয় পরিচয়পত্র) আছে, বউয়ের একটা আছে। যদি তা-ও না হয়, এমন অনেকে আছে যাঁরা অত সকালে এসে লাইনে দাঁড়াতে চাইবে না। তাঁদের একমাত্র ভরসা আমরা। ভ্রমণকারীর আইডি কার্ড দিয়েই না হলে টিকিটটা কেটে রাখব। পারিশ্রমিক হিসেবে যা দেয়, তা দিয়েই সংসার চলে যাবে। দিন পরে থাকবে না ভাই।’

এদিকে নতুন নিয়মে টিকিট সংগ্রহ করতে এসে অনেকে ভোগান্তিতে পড়েছেন। যাত্রীদের মধ্যে অনেকেই নতুন এ নিয়ম চালুর বিষয়ে জানেন না। তবে ভোগান্তির পাশাপাশি স্বস্তিও প্রকাশ করেছেন অনেক যাত্রী। প্ল্যাটফর্মে টিকিট কাটতে আসা মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘খুবই ভালো উদ্যোগ। আমার নিবন্ধন করাই ছিল। এসেই টিকিট পেলাম। ব্যবসার কাজে নিয়মিত দিনাজপুর-ঢাকা যাতায়াত করতে। আগে অসংখ্যবার টিকিটের জন্য ঘুরে গেছি। কিন্তু এখন এই সমস্যা হবে না, ভাবতেই ভালো লাগছে।’
গতকাল বিকেলে স্টেশন চত্বর ঘুরে দেখা যায়, টিকিটের জন্য দুটি লাইনে প্রায় ৫০ জন যাত্রী দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগ যাত্রীই নিবন্ধন করায় ব্যস্ত। নিবন্ধনের জন্য প্ল্যাটফর্মে পৃথক কোনো নিবন্ধন বুথ করা হয়নি। তবে রেলওয়ের কয়েকজন কর্মচারী কর্মকর্তা যাত্রীদের নিবন্ধনের বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এ সময় আলাউদ্দিন নামের মাঝবয়সী এক ব্যক্তি কিছুটা বিরক্ত হলেন। তিনি বলেন, ‘এই নিয়ম যদি করা হয়ে থাকে তাহলে আগে থেকেই জানানো উচিত ছিল। আমরা তো কিছুই জানতে পারিনি।’
দিনাজপুর রেলস্টেশনে টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে অন্তত ৪৫ থেকে ৫০ জন যুক্ত আছেন বলে জানালেন তাঁরা। দিনাজপুর ছাড়াও সেতাবগঞ্জ, পার্বতীপুর ও ফুলবাড়ীতেও তাঁদের ‘নেটওয়ার্ক’ আছে।
এদিকে টিকিট হাতে পেয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘নিজে নিবন্ধন করতে পারিনি। পাশে থেকে একজন করে দিল। ভালোই লাগছে। এত সুন্দর নিয়মের পরও যদি কালোবাজারি বন্ধ না হয়, তাহলে আমাদের দেশে আসলে এটা কোনোদিনই ঠিক হবে না।’
দিনাজপুর রেলস্টেশনের সুপারিন্টেন্ডেন্ট এ বি এম জিয়াউর রহমান বলেন, ‘যাত্রীরা নতুন নিয়মে টিকিট পাওয়ার পরে অনেক খুশি। তবে প্রথম প্রথম বিষয়টি বুঝতে অনেকের অসুবিধা হচ্ছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি, নিবন্ধনে সহায়তা করার। আগামীকাল থেকে অতিরিক্ত স্বেচ্ছাসেবক রাখা হবে। এই প্রক্রিয়া খুবই ভালো। এতে যাত্রীদের টিকিট প্রাপ্তিতে ভোগান্তি কমবে। তবে যিনি ভ্রমণ করবেন, অবশ্যই তিনি কারও ওপরে ভরসা না করে টিকিট নিজেই সংগ্রহ করবেন। তাহলে খারাপ সুবিধা কেউ নিতে পারবে না।’
Add comment