Nazihar News Network
News from Nazihar It Solution Limited

স্যার ডাকা সম্মানের না অহংকারের, সমাধানের উপায় কী

স্যার শব্দের বেশ সহজ অর্থ হলো ‘জনাব’। আমরা ছোটবেলা থেকেই আমাদের শিক্ষকদের স্যার বলতাম এবং এখনো বলি। তবে সেটা শুধু নিতান্তই স্যার ডাক নয়; বরং সেই বলার মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ড রকমের বিনয়, সম্মান ও শ্রদ্ধা। সম্মানটা মনে হয় সবাই আমরা পরিবার থেকেই শিখি এবং মন থেকেই করি। এ ছাড়া চাকরির ক্ষেত্রে অনেক সময় বস/উচ্চপদস্থ যিনি থাকেন (পৃথক চাকরির পৃথক নিয়ম/প্রচলন অনুযায়ী), অফিসে তাঁকে স্যার ডাকা হয়।

স্যার শব্দের বেশ সহজ অর্থ হলো ‘জনাব’। আমরা ছোটবেলা থেকেই আমাদের শিক্ষকদের স্যার বলতাম এবং এখনো বলি। তবে সেটা শুধু নিতান্তই স্যার ডাক নয়; বরং সেই বলার মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ড রকমের বিনয়, সম্মান ও শ্রদ্ধা। সম্মানটা মনে হয় সবাই আমরা পরিবার থেকেই শিখি এবং মন থেকেই করি। এ ছাড়া চাকরির ক্ষেত্রে অনেক সময় বস/উচ্চপদস্থ যিনি থাকেন (পৃথক চাকরির পৃথক নিয়ম/প্রচলন অনুযায়ী), অফিসে তাঁকে স্যার ডাকা হয়।

সম্প্রতি আমরা প্রায়ই খেয়াল করি, স্যার ডাকের মধ্যে যিনি ডাকবেন তার চেয়ে, যাকে ডাকবেন, তারই বেশি আগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে স্যার বলে সম্বোধন না করলে সরকারি সেবাদানকারী কর্মচারীরা সেবাগ্রহীতা সাধারণ নাগরিকদের বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছেন। কিন্তু, সরকারি কর্মচারীদের অবশ্যই মনে রাখা উচিত, তাঁরা জনগণের সেবক। একজন সাধারণ কৃষক-শ্রমিকের ট্যাক্সের টাকায় সরকারি কোষাগার থেকে তিনি বেতন নেন। তাই একজন নাগরিককে যতই সাধারণ হোন না কেন, পর্যাপ্ত বিনয়ের সঙ্গে সেবাদান ও সম্মান প্রদান করা উচিত।

স্যার বলার সংস্কৃতিটি ঔপনিবেশিক। সরকারি অনেক সম্মানিত কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী এখনো সেই সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারেননি। তবে মানসিকতার পরিবর্তন না হলে এ পরিস্থিতির উন্নতি করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারীদের সে চিন্তাধারা থেকে বের করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও তেমন কোনো পদক্ষেপ কিংবা উদ্যোগ নেই।

সরকারি কর্মচারীরা জনগণের সেবক, প্রভু নয়—চাকরিতে প্রবেশের সময় বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে, তা কর্মকর্তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে এবং শীর্ষ ব্যক্তিদের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনার মধ্য দিয়ে এমন পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি সম্ভব হতে পারে। পাশাপাশি দুই পক্ষের জন্য সম্মানজনক একটি সম্বোধন নির্ধারণ কিংবা আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, কর্মকর্তাদের নাম ধরে ডাকার সংস্কৃতি চালু করার মাধ্যমেও এমন সমস্যার সমাধান হতে পারে।

বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রায় ৪০ বছর আগের একটি আচরণ বিধিমালা আছে। এ আচরণবিধি অবশ্য ২০০২ সালে ও ২০১১ সালে দুই দফায় সংশোধিত হয়েছে। এখানে মোট ৩৪টি নির্দেশনা থাকলেও নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো বিধি নেই। তবে এটাও খেয়াল রাখা উচিত, ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায় নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে, এমনটি লেখা আছে। সেখানে অসদাচরণ বলতে বোঝানো হয়েছে, অসংগত আচরণ, চাকরি-শৃঙ্খলা হানিকর আচরণ কিংবা শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণকে। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সব সময় জনগণের সেবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। তাই জনগণকে ‘স্যার’ সম্বোধনে বাধ্য করার বিষয়টি কতটা ন্যায্য, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।

সম্প্রতি রংপুরের জেলা প্রশাসককে স্যার বলতে বাধ্য করার অভিযোগ করেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক। গত বুধবার সন্ধ্যায় এ ঘটনার প্রতিবাদে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক তাৎক্ষণিকভাবে মেয়েকে নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন।

ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের অভিযোগ, জেলা প্রশাসককে স্যার সম্বোধন না করায় তিনি ক্ষুব্ধ হন। এ সময় বিষয়টি নিয়ে দুজনের মধ্যে তর্কবিতর্ক হয়। এরপর সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তিনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নিচে প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। বিষয়টি জানাজানি হলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা ছুটে এসে সেই কর্মসূচিতে অংশ নেন। পরে অবশ্য জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন কার্যালয় থেকে নেমে এসে দুঃখ প্রকাশ করলে বিষয়টির সেখানে ইতি ঘটে। তবে এমন ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ ঘটছে, যেখানে একজন সাধারণ মানুষ, যিনি কিনা সেবা পাওয়ার উদ্দেশ্যে সরকারি কর্মচারীদের কাছে যান। সেখানে তাঁকে স্যার ডাকতে বাধ্য করানো হচ্ছে এবং এ নিয়ে তাঁকে অনেকাংশেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরতে হচ্ছে। কিন্তু সংবিধানে বলা আছে, সব সময় জনগণের সেবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।

একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অষ্টম বেতনকাঠামোতে ‘কর্মকর্তা’ বলে কোনো শব্দ রাখা হয়নি। সেখানে সবাই কর্মচারী। দেশে এখন ‘কর্মকর্তা’নেই। ‘স্যার’ ডাকতে হবে, এমন জায়গা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। মানসিক জায়গাটি পরিবর্তন করা জরুরি। পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীরা জনগণের সেবক। জনগণকে সেবা দেওয়ার জন্য জনগণের করের টাকায় তাঁদের বেতন দেওয়া হয়। কাউকে ‘স্যার’ ডাকতে হবে, এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সম্মান একটি বিমূর্ত বিষয়। স্যার না বলেও সম্মান করা যায়। পৃথিবী এসব জায়গা থেকে অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু আমরা এখনো বেরোতে পারিনি। কেউ সম্মানের যোগ্য হলে তাঁকে এভাবে সম্মান আদায় করতে হয় না। সম্মান অর্জনের বিষয়।

মোদ্দাকথা, সরকারি কর্মচারীরা জনগণকে কী বলে সম্বোধন করবেন, সে বিষয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে। উন্নত ও সভ্য রাষ্ট্রে সেবা নিতে যাওয়া নাগরিকেরা সরকারি কর্মচারীদের নাম ধরে সম্বোধন করেন। বাংলাদেশেও এখন সরকারি কর্মচারী আইন সংশোধন করে সেখানে ‘সম্বোধন’ নামে একটি নতুন ধারা যুক্ত করা দরকার, যেখানে স্পষ্ট বলা থাকবে, ‘সেবাগ্রহীতা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীগণের নাম উচ্চারণ করিয়া সম্বোধন করিতে পারিবেন।’ এ বিধান করা হলেই কেবল সরকারি কর্মচারীদের স্যার সম্বোধন শোনার আকাঙ্ক্ষা দূর হবে। পাশাপাশি এটাও সবাইকে মনে রাখতে হবে, মন থেকে শ্রদ্ধা-ভক্তি, সম্মান কিংবা বিনয় থাকলে অনেক জোর করিয়ে স্যার ডাকাতে হবে না; বরং আপনি না চাইলেও আপনাকে স্যারের চেয়েও বেশি মর্যাদা দেবে।
লেখক: মো. শাহ জালাল মিশুক, সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Add comment

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.