একজন ‘অবৈধ অধ্যক্ষকে’ রক্ষার জন্য নানামুখী চেষ্টা এবং কিছু ব্যক্তির ‘স্বার্থের দ্বন্দ্বে’ সমস্যায় পড়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যার বিবেচনায় রাজধানীর অন্যতম বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই সংকট এখন এতটাই বেশি যে এখন প্রতিষ্ঠানের দুটি পক্ষ পাল্টাপাল্টি ছুটি ঘোষণা, মামলা-মোকদ্দমার মধ্য দিয়ে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। আর এতে ক্ষতির মুখে পড়েছে হাজারো শিক্ষার্থী।
শিক্ষক ও একাধিক অভিভাবকের অভিযোগ, সরকারের একাধিক সংস্থার তদন্তে ‘অবৈধ’ হওয়া অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেন এবং পরিচালনা কমিটির সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তির নানা পদক্ষেপের কারণেই মূলত সমস্যাটি প্রকট হয়েছে। তাঁরাই মিলে এখন একটি পক্ষ হয়েছে। আরেকটি পক্ষে আছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) নির্দেশে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেওয়া জ্যেষ্ঠতম শিক্ষক মো. জাকির হোসেন। প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষক এখন তাঁর পক্ষে রয়েছেন। গতকালও তাঁর পক্ষ হয়ে অনেক শিক্ষক বিদ্যালয়ে যান।
এদিকে পরিচালনা কমিটির সভাপতি এ কে এম দেলোয়ার হোসেনের স্কুল ছুটি ঘোষণাকে এখতিয়ারবহির্ভূত ও সরকারের জারি করা নির্দেশনা অমান্য করার শামিল বলেছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। ৭ মার্চ এক নোটিশে দেলোয়ার হোসেন ১৫ মার্চ পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। নোটিশে মাউশির নির্দেশনা অনুযায়ী জাকির হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি অবহেলা করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। এ জন্য তাঁকে কেন অব্যাহতি দেওয়া হবে না, সে বিষয়ে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, তিন দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে দেলোয়ার হোসেনকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন গতকাল এক দিনের ছুটি দিলেও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তিনিসহ অন্য শিক্ষকেরা প্রতিষ্ঠানে যান।
দুপুরের পর এ প্রতিবেদক মূল ক্যাম্পাসে গেলে ফটক বন্ধ দেখতে পান। সেখানে পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবককে পাওয়া গেল। তিনি প্রথম আলোকে জানালেন, মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও অধ্যক্ষ পদে ফরহাদ হোসেনকে রাখার চেষ্টা এবং এখান থেকে কারও কারও লাভবান হওয়ার কারণেই মূলত এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়। এখন উচ্চমাধ্যমিকও চালু হয়েছে। মূল ক্যাম্পাসসহ কয়েকটি শাখায় শিক্ষার্থী প্রায় ৪০ হাজার। শিক্ষক আছেন আট শতাধিক। প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হয় ১৯৮৩ সালে। তবে সব শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত নন।
একসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও বর্তমান শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার। পরে তাঁর পরিবর্তে পরিচালনা কমিটির সভাপতি হন তাঁর মেয়ে। আর এখন অস্থায়ী পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে আছেন এ কে এম দেলোয়ার হোসেন।
শিক্ষকেরা জানালেন, এমপিওভুক্তি বাদ দিয়ে পরিচালনা কমিটির সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তি ও অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে আসা ফরহাদ হোসেন মিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে একটি ট্রাস্টের অধীনে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেন। তখন থেকেই (২০১৬) সমস্যার শুরু হয়।
মাউশি, ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ও প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, সরকারের নীতিমালা উপেক্ষা করে ৬০ বছর বয়স হওয়ার পরও ফরহাদ হোসেনের (অধ্যক্ষ) চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয়। মাউশি ও ঢাকা বোর্ডের তদন্তে বেরিয়ে আসে, ফরহাদ হোসেনের মেয়াদ বৃদ্ধি বিধিসম্মত হয়নি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) পৃথক এক তদন্তে উঠে আসে, নিয়ম না থাকলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি, সদস্যসচিব ও সদস্যরা মিলে ছয় বছরে সম্মানীর নামে দেড় কোটি টাকা নিয়েছেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন খাতে কোটি কোটি টাকা নয়ছয় করা হয়।
কয়েকজন শিক্ষক অভিযোগ করেন, একটি পক্ষ এখান থেকে দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে লাভবান হয়ে আসছিল। কিন্তু এখন সেটি বাধার মুখে পড়েছে। এ বিষয়ে সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, মঙ্গলবার তিনি দেশের বাইরে গেছেন।
Add comment