সিমটম আর রংতামাশা
পেশাদার কোনো স্টুডিওতে নয়, অনেকটা ঘরোয়া আয়োজনে গান পরিবেশন করে রাতারাতি পরিচিতি পেয়েছেন চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার রাজুরকান্দির বাসিন্দা খাইরুল বাশার। ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, হারমোনিয়ামে সুর তুলে তিনি গাইছেন, ‘তোমার সিমটম আর রংতামাশা ভালো লাগে না।’ পাশে একজন ঢুলি, গানের তালে কয়েকজনকে নাচতে দেখা যায়। গানের কথা আর সুরের প্রশংসা করছেন অনেকে।
কোন প্রেক্ষাপটে গানটি লিখেছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে খাইরুল বাশার বলেন, ‘এক মেয়েকে ভালোবাসি, সে আমাকে ভালোবাসার আশা দিয়েছে। কিন্তু পরে জানলাম, সে আমার সাথে ছলনা, সিমটম, অভিনয়, রংতামাশা করছে। সেটা আমি বুঝে ফেলেছি। তখন লিখলাম, তোমার সিমটম আর রংতামাশা ভালো লাগে না, ব্যবহারে বুঝতে পারছি তুই আমার হবি না।’ গানটা আপনার জীবন থেকে গানটা নেওয়া? ‘নাহ, আমার জীবন থেকে নেওয়া না। আমাদের চারপাশে হামেশাই এমন ঘটনা দেখি। চারপাশে পাওয়া জ্ঞান থেকে লিখেছি।’
২০ দিন আগে গানটি লিখেছেন তিনি, দিন দশেক আগে কণ্ঠ দেন খাইরুল। গানের ভিডিও ধারণ করে ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করেছে তাঁর ছেলে। খাইরুল বাশারের ইউটিউব চ্যানেলে গানটির খুব বেশি ‘ভিউ’ হয়নি, পরে সেখান থেকে কে বা কারা ফেসবুকে প্রকাশ করলে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে।
পথ খুলে দিল ইউটিউব
গানের নেশায় দেড় দশক আগে ঢাকায় এসেছিলেন খাইরুল, স্বরলিপি স্টুডিওতে নিজের লেখা ‘আমি তোমার দেওয়ানা’সহ কয়েকটি রেকর্ড করেছিলেন, তবে প্রকাশ করেননি। খাইরুলের ভাষ্যে, ‘তখন সবাই মেমোরি কার্ডে গান ভরে মোবাইলে চালায়, এত টাকা বিনিয়োগ করে ক্যাসেট বের করলে ব্যবসা করতে পারব না। ফলে অ্যালবামটি আর বাজারে ছাড়িনি।’ অনেকটা হতাশা নিয়েই গ্রামে ফিরেছিলেন খাইরুল, গ্রামে গিয়ে অনেকটা নীরবে গান চর্চা করে গেছেন।
খাইরুল বাশারের নামে গত বছর ইউটিউব চ্যানেলটি খোলে ছেলে। ছেলের উৎসাহেই গান নিয়ে প্রথমবার ক্যামেরার সামনে আসেন। কণ্ঠে তুললেন নিজের লেখা গান, ‘বেশি ফাল পারিস না, পালাইবার জায়গা পাবি না।’ মুঠোফোনে ধারণকৃত ভিডিওটি গত বছরের আগস্টে ইউটিউবে প্রকাশের পর আলোচিত হয়। শ্রোতাদের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়ে জোর পান খাইরুল; এর মধ্যে ‘আমি একটা প্রেম করছিলাম স্কুলজীবনে’, ‘যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন একটা প্রেম করি’সহ বেশ কয়েকটি গান প্রশংসিত হয়েছে।
এবার ঢাকা-ই খুঁজে নিল খাইরুলকে
ঢাকা থেকে গ্রামে ফেরার প্রায় দেড় দশক পর ইউটিউবের কল্যাণে চাঁদপুরের নিভৃত গ্রাম থেকেই নিজের অবস্থান জানান দিয়েছেন খাইরুল, তাঁর কয়েকটি গান ‘ভাইরাল’ হওয়ার পর অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ঈগল মিউজিক খাইরুলকে খুঁজে বের করে। খাইরুলের পাঁচটি গান রেকর্ডিংয়ের প্রস্তাব দেয় তারা।
ঢাকা থেকে রাজুরকান্দি গিয়ে খাইরুলের কাছ থেকে তাঁর লেখা ও সুরারোপ করা ‘আমি একটা প্রেম করছিলাম স্কুলজীবনে’, ‘যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন একটা প্রেম করি’সহ পাঁচটি গান নিয়ে আসে ঈগল মিউজিক। খাইরুলের কথা ও সুরে ঈগল মিউজিকের ব্যানারে ‘যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন একটা প্রেম করি’ গানে কণ্ঠ দেন তরুণ গায়ক সৌরভ ইসলাম। গত ৯ ফেব্রুয়ারি ঈগল মিউজিকের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশের পর গানের ভিডিওটি এ পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখবার ‘ভিউ’ হয়েছে। বাকি গানগুলোও প্রকাশ করবে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি।

স্টুডিও নেই, তো কী
বছরখানেক ধরে ইউটিউবে নিজের গান প্রকাশ করেন খাইরুল বাশার, রেকর্ডিংয়ের জন্য পেশাদার কোনো স্টুডিও না পেলেও থেমে যাননি তিনি। নিজের কোনো বাদ্যযন্ত্রও নেই, পাশের গ্রাম লবারকান্দির ঢুলি হুমায়ূন মোল্লার বাড়িতে গিয়ে গান পরিবেশন তিনি। হুমায়ূন মোল্লার বাড়িই তাঁদের কাছে স্টুডিও। একসঙ্গে ৮ থেকে ১০টির মতো গান নিয়ে সেখানে যান খাইরুল, সব কটির ভিডিও ধারণ করে ফেরেন। আলোচিত ‘সিমটম আর রংতামাশা’ গানটিও হুমায়ূন মোল্লার বাড়িতেই ধারণ করা। আগে মুঠোফোনে গানের ভিডিও ধারণ করা হতো, এখন একটি ক্যামেরা কিনেছেন। ভিডিও ধারণের পাশাপাশি সম্পাদনা ও ইউটিউব চ্যানেলের দেখভাল করে খাইরুলের ছেলে শাওন।
গানে এলেন কীভাবে
‘শৈশবে টিভি দেখার সময় ভাবতাম, ভেতরে মানুষ কীভাবে এত সুন্দর করে গান গায়। তখন থেকেই শিল্পী হওয়ার ইচ্ছা ছিল,’ বলেন খাইরুল বাশার। কৈশোরে আশপাশের দশ গ্রামে নানা আসরে গান শুনতে যেতেন খাইরুল। এক আসরে পালাশিল্পী সুজন সরকারের সঙ্গে পরিচয়। সংগীতজীবনে তাঁকেই গানের গুরু মানেন খাইরুল। নিজে পালাশিল্পী হতে চেয়েও পারেননি খাইরুল, তবে সুজন সরকারই তাঁর গানের দুনিয়ার কপাট খুলে দিয়েছিলেন। গুরুর অনুপ্রেরণায় গান লেখায় মনোযোগ দেন খাইরুল। তাঁর আগে হাইস্কুল–জীবনে টুকটাক কবিতা লেখার অভ্যাস ছিল, স্কুলের সাংস্কৃতিক আয়োজনে আবৃত্তিও করেছেন খাইরুল।

পেশায় কাঠমিস্ত্রি, নেশায় গান
খাইরুল বাশারের ভাষ্যে, একসময় তাঁদের পরিবার বেশ সচ্ছল ছিল। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ঝিনাইয়া উচ্চবিদ্যালয়ে, স্বপ্ন ছিল শিক্ষিত হয়ে নাম করবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন অঙ্কুরেই ঝরে যায়। ১৯৯৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন খাইরুল, এর মধ্যে তাঁদের সংসারের আর্থিক অবস্থাও টালমাতাল হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে জীবিকার সন্ধানে গেলেন দূর গ্রামে। কাঠমিস্ত্রির কাজ করে বাড়িতে অর্থ পাঠাতেন কিশোর খাইরুল। খাইরুলের এই সংগ্রামের পেছনে মধ্যবিত্ত মানসিকতাও ভূমিকা রেখেছিল। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা জমিদারি স্টাইলে চলেছেন, আমাদের খাওয়া–পরায় কোনো কমতি করেননি। কিন্তু একসময় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন বাবা। আশপাশের মানুষকে আমরা বুঝতে দিইনি, আমাদের আর্থিক অবস্থা কতটা খারাপ।’ সেই থেকে দুই দশক ধরে কাঠের কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন খাইরুল। দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে খাইরুলের সংসার। দুই ছেলেই পড়াশোনা করছেন।
সংগ্রামমুখর জীবনে খাইরুলের নিজের বলতে ওই গান। নেশা বলতেও গান। জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও গানকে আঁকড়ে ধরে আছেন খাইরুল।
গানের মাঝেই বাঁচতে চান
এ পর্যন্ত অন্তত ৩০০ গান রচনা করেছেন খাইরুল বাশার; কিছু গানে নিজে কণ্ঠ দিয়েছেন, কয়েকটি অন্য শিল্পীরা গেয়েছেন। গানের কথা ও সুরের মাঝেও শ্রোতাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকতে চান তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি বেঁচে থাকার পিয়াসে গানগুলো করতেছি, আমার গান অনেকে গাইতেছে। আমার স্বপ্ন একটাই—গানগুলো মানুষের হৃদয়ে যেন থাকে। আমার গানের মধ্যেই আমি বেঁচে থাকতে চাই।’







Add comment