Nazihar News Network
News from Nazihar It Solution Limited

সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণ: তদারকি ও নিরাপত্তায় ঘাটতি

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের কারখানায় বিস্ফোরণের পর সরকারি সংস্থাগুলোর তদারকিতে ঘাটতি থাকার বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। কারখানাটির বিস্ফোরক লাইসেন্স হালনাগাদ রয়েছে কি না, সেটি বিস্ফোরণের ২৪ ঘণ্টা পরও জানাতে পারেনি বিস্ফোরক অধিদপ্তর। এ ছাড়া কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের গাফিলতি ছিল বলে মনে করছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি।

কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের গাফিলতি ছিল বলে মনে করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি। নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৭।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের কারখানায় বিস্ফোরণের পর সরকারি সংস্থাগুলোর তদারকিতে ঘাটতি থাকার বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। কারখানাটির বিস্ফোরক লাইসেন্স হালনাগাদ রয়েছে কি না, সেটি বিস্ফোরণের ২৪ ঘণ্টা পরও জানাতে পারেনি বিস্ফোরক অধিদপ্তর। এ ছাড়া কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের গাফিলতি ছিল বলে মনে করছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি।

দুর্ঘটনার আগে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য কারখানায় দক্ষ জনবলের ঘাটতি থাকার কথাও জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

কারখানার বিস্ফোরক ছাড়পত্র হালনাগাদ রয়েছে কি না, তা জানতে চাইলে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. তোফাজ্জল হোসেন গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তিনি বলেন, ছাড়পত্র নবায়নের কাজটি বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ঢাকা কার্যালয় থেকে হয়। সেখান থেকে তথ্য জানার চেষ্টা করছেন তাঁরা।

পরে বিষয়টি নিয়ে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ঢাকা কার্যালয়ের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রথম আলো। তাঁরা বলেন, বিষয়টি চট্টগ্রামে খোঁজ করেন।

এদিকে তিনটি কারণে সীমা অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত, যে পাইপ দিয়ে সিলিন্ডারে অক্সিজেন ভরা হয়, সেটিতে ফাটল বা ছিদ্র হওয়া, দ্বিতীয়ত গ্যাস নিয়ন্ত্রণের ভালভে (যন্ত্রাংশ) ত্রুটি থাকা এবং সিলিন্ডারের ভেতরে ফাটল থাকা।

গত শনিবার বিকেলে সীতাকুণ্ড উপজেলার কদমরসুল এলাকায় সীমা অক্সিজেন কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সাতজন মারা গেছেন। গুরুতর আহত হন ২৪ জন। বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে কারখানার আশপাশের অন্তত এক বর্গকিলোমিটার এলাকা। বিচ্ছিন্ন লোহার টুকরা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বিস্ফোরণস্থল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূর পর্যন্ত উড়ে যায় লোহার পাত।

বিস্ফোরণের দিনই ছয়জন মারা যান। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন আরও একজন। তাঁর নাম লাল শর্মা (৫৫)। তিনি কারখানার সিনিয়র অপারেটর ছিলেন। এ নিয়ে সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল সাতজনে।

মালিকপক্ষের গাফিলতি

সীমা অক্সিজেন কারখানায় প্রাথমিক পরিদর্শনে মালিকপক্ষের গাফিলতি থাকার তথ্য পেয়েছেন জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য সুমন বড়ুয়া। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের চেয়ারম্যান।

গতকাল রোববার বিকেলে কারখানা পরিদর্শন শেষে সুমন বড়ুয়া সাংবাদিকদের বলেন, কারখানা পরিচালনার ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব ছিল। আবার মালিকপক্ষের গাফিলতিও ছিল। নিরাপদে প্ল্যান্ট (কারখানা) পরিচালনার ক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে খেয়াল করার কথা ছিল, তা করা হয়নি। এতে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। কারখানা পরিচালনার বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিতে পারেননি কারখানার তত্ত্বাবধায়ক।

অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস বলছে, কারখানাটি অনেক পুরোনো। যন্ত্রপাতিগুলো যেভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা ছিল, তা করা হয়নি।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সীতাকুণ্ডে এভাবে চলতে পারে না। সোমবার (আজ) বিষয়টি নিয়ে আমরা সভা ডেকেছি। সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাগুলো যাতে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করে, সে বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।’

তদারকিতে ঘাটতি

সীতাকুণ্ড সদর উপজেলা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ২৮ কিলোমিটার। স্থানীয় প্রশাসন ও ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, সীতাকুণ্ডে মাঝারি ও ভারী শিল্পকারখানার সংখ্যা ৩৮৫।

সীমা অক্সিজেন কারখানা চালু হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মামুন উদ্দিন দাবি করেন, সরকারি যেসব সংস্থার ছাড়পত্র দরকার, তার সবই হালনাগাদ করা আছে। বিস্ফোরণের বিষয়টিকে তাঁরা দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখছেন। এতে কারও কোনো হাত নেই।

তবে তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসান বলেন, পরিদর্শনের সময় তাঁরা কারখানায় কার্বন ডাই–অক্সাইড ও নাইট্রোজেনের সিলিন্ডার পেয়েছেন। এসব সিলিন্ডার রাখার অনুমোদন ছিল না।

অন্যদিকে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. তোফাজ্জল হোসেন জানান, কারখানাটিতে অক্সিজেন সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ ঘটেনি। প্ল্যান্ট থেকে যে কলামের (পাইপের মতো কাজ করে) মাধ্যমে সিলিন্ডারে অক্সিজেন ভরা হয়, সেটি বিস্ফোরিত হয়েছে। কী কারণে বিস্ফোরণ হয়েছে, তা নিশ্চিত হতে আরও নিবিড়ভাবে তদন্ত করবেন তাঁরা।

এর আগে গত বছরের ৪ জুন সীতাকুণ্ডের কেশবপুরে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ৫০ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক। বিস্ফোরণে ডিপোর একাংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। দুর্ঘটনার পর জেলা প্রশাসন ও বন্দরের তদন্ত কমিটির দুটি আলাদা প্রতিবেদনে বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির চিত্র উঠে আসে।

বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে প্রাণহানির ঘটনায় পুলিশের করা মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। মামলার আট আসামির মধ্যে কেউ গ্রেপ্তার হননি। তাঁরা এখন জামিনে রয়েছেন। মামলার অগ্রগতি বলতে থানা-পুলিশ থেকে তদন্তের দায়িত্ব গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশে স্থানান্তর।

আহত ব্যক্তিরা কাতরাচ্ছেন

দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা চলছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আর নিহত ছয়জনের মরদেহ গতকাল বিকেলে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

গতকাল বিকেলে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) ৬০ বছর বয়সী মাকসুদুল আলমের চিকিৎসা চলছে। তাঁর ডান পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। গতকাল সকালে জ্ঞান ফেরার পর তিনি বুঝতে পারেন একটি পা নেই।

পা কেটে ফেলতে হবে কারখানার আরেক কর্মী আতাউল গণি ওসমানেরও (৪৫)। তাঁর বাঁ পায়ের গোড়ালি থেকে ওপরের বেশির ভাগ অংশ হাড়সহ উড়ে গেছে।

হাসপাতালে চোখের আঘাত নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনজন। তাঁরা হলেন মো. আজাদ, নাহিন শাহরিয়ার ও মো. সোলায়মান। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের জখম নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ১৫ জন।

এ ছাড়া সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরও পাঁচজন।

গতকাল সকালে কারখানা ও এর আশপাশের এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে টিন ও লোহার টুকরা। আশপাশের অনেক ভবনের দেয়াল ফেটে গেছে। উড়ে গেছে টিনের চালা। ভেঙে গেছে অনেক ঘরের কাচ।

কারখানায় বিস্ফোরণ এতটাই প্রকট ছিল যে তার প্রভাব ছড়িয়েছে আশপাশের অন্তত এক বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে। সিলিন্ডারের লোহার পাত উড়ে গিয়ে পড়েছে আশপাশের ঘরের চালায়। বিকট শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা।

সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণের ঘটনায় জাতীয় পর্যায়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাত খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষায়িত কারখানাগুলোতে দক্ষ জনবলের যেমন অভাব রয়েছে, তেমনি তদারকিরও ঘাটতি আছে। তদারকির জন্য সরকারি সংস্থাগুলোতেও দক্ষ জনবল নেই।

বুয়েটের শিক্ষক ইয়াসির আরাফাত খান বলেন, দেশে শিল্পায়ন হচ্ছে। তবে রাসায়নিকের মতো বিশেষায়িত শিল্পের জন্য সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন (নীতিমালা) নেই। শিল্পের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতিমালা দরকার।

Add comment

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.