বাড়ির নাম ‘আতিয়া মহল’। পাঁচতলা এই বাড়ির অবস্থান সিলেট মহানগরের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকায়। এখানের নিচতলায় জঙ্গিরা অবস্থান করছে, এমন তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের ২৪ মার্চ ভোররাতে জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু করে পুলিশ। রাত শেষে ভোরের আলো ফুটলে পুলিশ দফায় দফায় জঙ্গিদের আত্মসমপর্ণের আহ্বান জানায়। জঙ্গিরা তাতে সাড়া না দিয়ে ভেতর থেকে গুলি, বোমা ছোড়ে। সেই ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে হওয়া মামলার রায়ে গতকাল বুধবার অভিযুক্ত তিনজন বেকসুর খালাস পেয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে ফিরে দেখা যাক সেই ঘটনা।
পুলিশের বাড়ি ঘেরাও
আতিয়া মহলের ২৮টি ফ্ল্যাটের মধ্যে নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে পরিচয় গোপন রেখে ভাড়া নিয়ে জঙ্গিরা অবস্থান করছে, এ তথ্যের ভিত্তিতেই ২০১৭ সালের ২৪ মার্চ শুক্রবার ভোররাতে পুলিশ বাড়িটি ঘেরাও করেছিল। তবে বারবার হ্যান্ডমাইকে আহ্বান জানিয়েও ভেতরে থাকা জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করাতে পারেনি পুলিশ। উল্টো ভেতর থেকে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। জঙ্গিদের কোনোভাবেই কাবু করতে পারছিলেন না পুলিশ সদস্যরা।
এক পর্যায়ে র্যাব সদস্যরাও যোগ দেন। কিন্তু তাতেও সমাধান মেলেনি; বরং ভবনের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিরা বিস্ফোরক লাগিয়ে রাখে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাড়িটিকে ঘিরে রাখে। সন্ধ্যার দিকে ঢাকা থেকে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট ‘সোয়াট’ আসে। তবে জঙ্গি আস্তনায় বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক থাকায় সোয়াট দল অভিযানে না নেমেই ফিরে যায়।
আশপাশের ভবনগুলো থেকে বাসিন্দারা ভয়ে ধীরে ধীরে সরে যান। তবে আতিয়া মহলের ভেতরে ২৮টি ফ্ল্যাটে আটকা পড়া বাসিন্দাদের স্বজনেরা উদ্বিগ্ন মুখে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। এভাবে কেটে যায় এক দিন, এক রাত।
‘অপারেশন টোয়াইলাইট’
২৫ মার্চ, শনিবার। সকাল থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছিল। হঠাৎ করেই একের পর এক সাঁজোয়া যান আসতে থাকে। সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ফোর্স চারপাশ ঘিরে ফেলে। আশপাশের বাসিন্দারা যাঁরা বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে ছিলেন, তাঁদের অন্তত এক কিলোমিটার দূরে সরে যাওয়ার নির্দেশনা দেন সেনা কমান্ডোরা। এরপরই বিচ্ছিন্ন করা হয় আতিয়া মহলের বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস-সংযোগ। মেঘলা আকাশের কারণে পুরো এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
সকাল ১০টার দিকে সেনাবাহিনী সাংবাদিকদের জানালেন, ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ শুরু হয়ে গেছে। তবে অপারেশন শুরুর পরই নামে প্রবল বেগে ঝড়-বৃষ্টি। বেলা ১১টার দিকে ঝড়-বৃষ্টি থামলে সেনাবাহিনী প্রথমে ভবনে আটকা পড়া বাসিন্দাদের উদ্ধারে চেষ্টা চালায়। এ সময় থেমে থেমে চলে পাল্টাপাল্টি গুলি-বিস্ফোরণ। একসময় পাশের একটি ভবনের মাঝখানে মই দিয়ে সেতু তৈরি করা হয়। বেলা সোয়া একটার মধ্যে ওই বাড়ি থেকে আটকে পড়া ৭৮ জন বাসিন্দাকে নিরাপদে বের করে আনেন সেনাসদস্যরা। দিনভর অভিযান চলে। সন্ধ্যায় সেনা কর্মকর্তারা আতিয়া মহলের পাশে এক বাসায় সংবাদ সম্মেলনে জানান, অপারেশন টোয়াইলাইট চলবে।
সংবাদ সম্মেলন শেষ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আতিয়া মহলের ঠিক কয়েক শ গজের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে দুই দফা বিস্ফোরণ ঘটে। এতে অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হন। চারপাশে শুরু হয় মানুষের আর্তনাদ আর রক্তাক্ত মানুষের ছোটাছুটি। এ ঘটনায় র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের তৎকালীন প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদ, দুই পুলিশ সদস্যসহ সাতজন নিহত হন। তাৎক্ষণিকভাবে এ হামলার দায় স্বীকার করে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস।
এমন পরিস্থিতিতে পরের দিন ২৬ মার্চ জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহলের আশপাশে নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়। ২৭ মার্চও কাটল একইভাবে। ২৮ মার্চ সকাল থেকে একটানা অভিযান চলল। জঙ্গিদের সঙ্গে লড়ে গেলেন সেনা কমান্ডোরা। ক্রমাগত বিস্ফোরণে পুরো বাড়িটি বিধ্বস্ত রূপ নেয়। গুলি আর বিস্ফোরণের কারণে আতিয়া মহলের ওপরে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেল দুপুরের দিকে। এরপর আতিয়া মহলের ভেতর থেকে সংক্ষিপ্ত বিরতিতে বিকট শব্দ ভেসে আসছে। এর কিছুক্ষণ পর আতিয়া মহলের ভেতরে সেনাবাহিনীর যান, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স ঢোকে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সেনাবাহিনী জানায়, আতিয়া মহল পুরোপুরি জঙ্গিমুক্ত। অভিযান শেষে এক নারীসহ চার জঙ্গির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে জানা যায়, চার জঙ্গিই আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন।
তিনটি মামলা, একটির রায়
ছয় বছর আগে আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান শেষে তিনটি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে হওয়া মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে। রায়ে অভিযুক্ত তিনজনকেই বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত। গতকাল বুধবার সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মুহাম্মদ নূরুল আমীন বিপ্লব এ রায় ঘোষণা করেন। তবে অন্য দুটি মামলা এখনো বিচারাধীন।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনে হওয়া মামলায় খালাসপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা হলেন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারীর তিন জেএমবি সদস্য জহুরুল হক ওরফে জসিম (২৯), মো. হাসান (২৮) ও জহরুল হকের স্ত্রী মোছা. আর্জিনা ওরফে রাজিয়া সুলতানা (২১)। রায় ঘোষণার সময় তিনজনই আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী আদালতের বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি মুমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দায়ের হওয়া তিন মামলার মধ্যে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে হওয়া মামলায় অভিযুক্ত তিনজন আসামি ঘটনার সময় আতিয়া মহলে উপস্থিত ছিলেন না। কারণ, তাঁরা এ ঘটনার আগেই একই ধারার অন্য মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে চট্টগ্রামের কারাগারে ছিলেন। ফলে আদালত তাঁদের বেকসুর খালাস দেন।
মুমিনুর রহমান আরও বলেন, বোমা বিস্ফোরণ ও হত্যার ঘটনায় হওয়া পৃথক দুটি মামলায় ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এ দুটি মামলা সিলেটের অন্য আদালতে বিচারাধীন আছে।







Add comment