Nazihar News Network
News from Nazihar It Solution

নৌকাডুবি থেকে যেভাবে বেঁচে ফিরলেন

ইঞ্জিনচালিত নৌকাটা মানুষ আর নানা রকম পণ্যের ভারে এমনিতেই ডুবুডুবু ছিল। মাঝনদীতে গিয়ে তাতে লাগল ঢেউয়ের ধাক্কা। ডুবতে বসা সেই নৌকায় যাত্রী ছিলেন সুনামগঞ্জের স্কুলশিক্ষক মনসুরা শুভ্রা। কীভাবে বেঁচে ফিরলেন? তাঁর মুখে সেই রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তের কথা শুনেছেন খলিল রহমান

ইঞ্জিনচালিত নৌকাটা মানুষ আর নানা রকম পণ্যের ভারে এমনিতেই ডুবুডুবু ছিল। মাঝনদীতে গিয়ে তাতে লাগল ঢেউয়ের ধাক্কা। ডুবতে বসা সেই নৌকায় যাত্রী ছিলেন সুনামগঞ্জের স্কুলশিক্ষক মনসুরা শুভ্রা। কীভাবে বেঁচে ফিরলেন? তাঁর মুখে সেই রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তের কথা শুনেছেন খলিল রহমান

ঘাটে গিয়ে দেখি একটি নৌকা প্রায় ঘাট ছেড়ে দিয়েছে। এটায় উঠতে না পারলে আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। স্কুলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। তাই অটোরিকশা থেকে নেমেই রীতিমতো দৌড়ে নৌকায় উঠে পড়ি।

নৌকাটার সামনের অংশে কয়েক বস্তা সিমেন্ট তোলা হয়েছে। তার ওপরই ঠাসাঠাসি করে বসেছেন যাত্রীরা। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন শিক্ষকও উঠেছিলেন। আমরা কেউই নৌকার পেছনের অংশে যেতে পারলাম না।

মুড়ারবন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমি। স্কুলটা সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার হলেও এলাকাটা বেশ দুর্গম। শহর থেকে প্রথমে অটোরিকশায় যেতে হয় সুরমা নদীর টুকেরবাজার খেয়াঘাটে। সেখান থেকে নৌকায় আরও ঘণ্টাখানেকের পথ।

নৌকাটা কিছু দূর যেতেই দেখি ঢেউয়ের তোড়ে সামনের দিকে পানি উঠছে। সিমেন্টের বস্তার ওপর দিয়েই নৌকার পেছন দিকে যাই। নৌকায় যে পানি উঠছে, আশপাশের সবাইকে জানাই। কিন্তু কেউ পাত্তা দিল না।

ঢেউয়ের তোড়ে আবার পানি উঠলে চিৎকার করে উঠি। নৌকা তীরে ভেড়াতে বলি। বলতে থাকি, ‘এই নৌকায় আমি যাব না।’ কিন্তু কেউই আমার কথা শোনেন না।

ডুবে যাওয়া নৌকা থেকে বেঁচে ফিরেন মনসুরা শুভ্রা
ডুবে যাওয়া নৌকা থেকে বেঁচে ফিরেন মনসুরা শুভ্রা

কীভাবে কী হলো, জানি না

আতঙ্ক নিয়ে দেখি নৌকায় পানি উঠছে। পাশের একজন জোরে জোরে দোয়া-দরুদ পড়তে শুরু করেন। আচমকা নৌকাটা পানিতে ভরে যায়। নৌকাটা আলগোছে তলিয়ে যেতে থাকে। প্রথমে আমার পা, তারপর কোমর, এভাবে বুক পর্যন্ত পানি উঠে যায়। তখনো আমার পায়ের নিচে নৌকা। হঠাৎ অনুভব করি, পায়ের নিচে কিছু নেই। দ্রুত তলিয়ে যেতে থাকি। মুখ বন্ধ, শ্বাস নিতে পারছি না। তলিয়ে যেতে যেতে ভাবলাম, আহা রে, কিছুক্ষণ পর সবাই জানবে আমি মারা গেছি।

হঠাৎ খুব গতিতে পানির নিচ থেকে ভেসে উঠি। আমার ছেলে দুটোর কথা মনে পড়ে। আবার বাঁচার চেষ্টা করি। কিছুই দেখি না, হাতে যা–ই পাই, আঁকড়ে ধরি। দেখি, যাঁকে ধরেছি, তিনিও পানিতে ডুবে যাচ্ছেন। কী সর্বনাশ, মানুষটা তো মারা যাবেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ছেড়ে দিই। পা দুটো নাড়াতে শুরু করি। আমার এক পাশে বয়স্ক এক লোক, অন্য পাশে তিন নারী। তাঁদের বারবার কেঁদে কেঁদে বলতে থাকি, আমি সাঁতার জানি না। তবু কেউ আমাকে ধরতে এগিয়ে আসেন না। সাঁতরে পাড়ের দিকে চলে যান তাঁরা। আমি প্রাণপণে মাথাটা ভাসিয়ে জোরে জোরে ‘আল্লাহ’, ‘আল্লাহ’ ডাকি আর সর্বশক্তি দিয়ে পা নাড়াই। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই আসবে। আমি জানি, ডুবে গেলে এই খরস্রোতা সুরমায় আমাকে কেউ খুঁজে পাবে না।

সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার গ্রামগুলোর পথ এমনই দুর্গম
সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার গ্রামগুলোর পথ এমনই দুর্গম

একটা নৌকা আসছে

এভাবে কতক্ষণ কাটে, জানি না। আর শক্তি পাচ্ছিলাম না। চারদিকে তাকাই। কেউ আসছে না। আমি নিশ্চিত, আমাকে মরতেই হবে। ওপরে তাকিয়ে কলেমা পড়ি। আমার পা স্থির হয়ে আসে। তলিয়ে যেতে থাকি। চোখে পানি ঢুকছে। কেন যেন খুব কষ্টে আবার চোখ মেলে তাকাই, হয়তো পৃথিবীকে শেষবার দেখতে চাই। আর তখনই ঝাপসা চোখে দেখতে পাই, দূর থেকে মাছ ধরার দুটো ছোট নৌকা আসছে।

সঙ্গে সঙ্গে গায়ের সব শক্তি দিয়ে আবার পা নাড়াতে শুরু করি। আমি ভাসছি, ডুবছি, আর পানি খাচ্ছি। ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে লড়াই করে ভাসতে ভাসতে আবার পা অসাড় হয়ে যায়। আবার তলিয়ে যেতে থাকি। ঠিক তখনই কেউ একজন আমার দিকে একটি হাত বাড়িয়ে দেন। আমিও শক্ত করে ওই হাত ধরি। তিনি সাঁতরে আমাকে নৌকার কাছাকাছি নিয়ে যান। সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগতে থাকে। ওই বয়স্ক চাচা আর আমি নৌকা ধরে পানিতে ভেসে আছি। আরেকজন নৌকা বেয়ে পাড়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। নৌকাটি তীরের কাছাকাছি পৌঁছাতেই চাচা বললেন, ‘মাগো, আর ভয় নাই। তুমি পা দিয়ে এখন মাটি ছুঁতে পারবে।’

পাড়ে তোলার পর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে জেনেছি, সহকর্মীরা আরেকটি নৌকা ভাড়া করে আমাকে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে আসেন। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য আমাকে সুনামগঞ্জ থেকে সিলেটে নিয়ে আসেন আমার স্বামী।

ঘটনাটা ঘটেছে গত বছরের ১৮ অক্টোবর। এরপর কয়েক মাস একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। বারবার সেই মুহূর্তের কথা মনে পড়ত। কীভাবে বাঁচলাম, কীভাবে কী হলো—এই সব। এখনো ঘটনাটার খণ্ড খণ্ড চিত্র হঠাৎ করেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তখন হাত-পা অবশ হয়ে যায়, অস্থিরতা শুরু হয়। রাতে ঘুমের মধ্যে কোনো কারণে খাট নড়াচড়া করলে ‘নৌকা ডুবে যাচ্ছে’, ‘নৌকা ডুবে যাচ্ছে’ বলে চিৎকার করে উঠি। চিকিৎসকেরা বলেছেন, এই ঘোর কাটতে সময় লাগবে। আমার মনে হয়, আমি কখনো এই ঘটনা ভুলতে পারব না। যত দিন বাঁচব, এই দুঃসহ স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে।

Add comment

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.