যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট তিনি। তাঁর জনসমর্থনের পারদও নিম্নমুখী। এখন তাঁর প্রতি জনসমর্থন ৪০ শতাংশের নিচে। এবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কি না, তা নিয়ে এখনো সন্দেহ-সংশয় রয়েছে। অবশ্য ৮০ বছর বয়সী এই প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠরা বলছেন, শিগগিরই তিনি প্রার্থিতার ঘোষণা দেবেন। তবে যাঁকে নিয়ে এত কথাবার্তা, সেই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজ থেকে এখনো কিছু বলছেন না।
এক জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, ডেমোক্রেটিক পার্টির অধিকাংশ নেতা-কর্মী চান, বাইডেন নন, আগামী নির্বাচনে দল থেকে অন্য কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন। তবে তিনি নির্বাচনে লড়তে চাইলে কেউ তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন না।
কিন্তু বাইডেন যদি নিজে থেকেই সরে যান, তাহলে কী হবে।
ইতিমধ্যে ডেমোক্রেটিক পার্টির দুজন নেতা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাঁরা ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রচারও শুরু করেছেন। এ দুজন ছাড়া আরও কয়েকজন এই কাতারে শামিল হতে পারেন। দেখা যাক, কারা তাঁরা।
মেরিয়ানা উইলিয়ামসন

মেরিয়ানা উইলিয়ামসন প্রথম ডেমোক্র্যাট নেতা, যিনি ২০২৪ সালের নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছেন। তিনি গত মার্চে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন।
দীর্ঘদিনের সামাজিক বিচার আন্দোলনের কর্মী, সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের লেখক এবং অপরাহ উইনফ্রের ‘আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা’ ৭০ বছর বয়সী মেরিয়ানা ২০২০ সালে প্রথম রাজনীতির মঞ্চে আসেন।
বয়সের কারণে বাইডেন সরে দাঁড়ালে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে মেরিয়ানা উইলিয়ামসন, রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র, কমলা হ্যারিস, গ্যাভিন নিউসম, বার্নি স্যান্ডার্স, জে বি প্রিৎসকার, ফিল মারফি, অ্যামি ক্লোবুচার বা এলিজাবেথ ওয়ারেনের মতো যে কাউকে দেখা যেতে পারে হোয়াইট হাউসের দৌড়ে
২০২০ সালে ডেমোক্র্যাটদের প্রাথমিক বাছাইয়ের বিতর্কে প্রথম দৃষ্টি কাড়েন মেরিয়ানা। তখন তিনি বলেছিলেন, ট্রাম্পকে হারানোর পথ একটাই। ‘ভালোবাসাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে’ হবে।
ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাথমিক বাছাই নির্বাচন শুরুর আগেই মেরিয়ান সরে দাঁড়িয়েছিলেন। তবে প্রগতিশীল বামদের কাছে তিনি ‘স্পষ্টবাদী কণ্ঠ’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।
২০২৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে মেরিয়ান ইতিমধ্যে কিছু প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। তিনি সরকারচালিত সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা চালু, ক্রীতদাস কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের জন্য ৮০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ এবং শান্তি দপ্তর নামে আলাদা একটি সংস্থা খোলার কথা বলছেন।
রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র

টিকাবিরোধী কর্মী রবার্ট এফ কেনেডি আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ইতিমধ্যে কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। এপ্রিলের শেষ নাগাদ তিনি নির্বাচনী প্রচার শুরু করতে পারেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
রবার্ট এফ কেনেডি হলেন প্রয়াত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাতিজা এবং নিহত মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল ববি কেনেডির ছেলে। কেনেডি পরিবারের ১২তম সদস্য, যিনি জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের দৌড়ে নামছেন।
রাজনৈতিক বোদ্ধারা আরও দুজনকে এই তালিকা থেকে একেবারে বাদ দিতে চান না। তাঁরা হলেন সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। কেউ কি বলতে পারেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুইবার ব্যর্থ হিলারি ক্লিনটন এবার থাকবেন না? ডেমোক্র্যাট ভোটারদের কাছে এ দুই নারীই বেশ জনপ্রিয়।
দীর্ঘদিন পরিবেশ আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন। নিউইয়র্কের হাডসন নদীর পানি পরিচ্ছন্ন রাখার দাবিসহ বিশুদ্ধ পানির মতো ইস্যুতে কাজ করে রবার্ট এফ কেনেডি বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
তবে টিকাবিরোধী প্রকাশ্য অবস্থান নিয়ে ৬৯ বছর বয়সী কেনেডি ও তাঁর পরিবার জনগণ থেকে কিছুটা দূরে সরে গেছেন। টিকা নিয়ে তাঁর ষড়যন্ত্রতত্ত্বের অবস্থানকে বেশির ভাগ মানুষ ‘চরম ভুল’ বলে মনে করেন।
সর্বশেষ কোভিড-১৯-এর টিকা নিয়েও কেনেডি সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ করেছেন। তবে মহামারির সময় তিনি নতুন একদল মানুষকে তাঁর সঙ্গে পেয়েছেন। টিকাবিরোধী প্রচার চালিয়ে ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের আয় দ্বিগুণ করেছেন।
কমলা হ্যারিস

সম্ভবত এক বয়স্ক প্রেসিডেন্টের সহকারী হয়ে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন কমলা হ্যারিস। তাঁর মতো সুবিধা আর কেউ পাবেন বলে মনে হয় না। সাবেক কৌঁসুলি, ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও সিনেট সদস্য কমলা (৫৮) যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ২০২০ সালে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রথম এশীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনও বটে। কারণ, তাঁর মায়ের আদি নিবাস ভারত।
২০২১ সালের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কোলনোস্কোপির অস্ত্রোপচার হলে ৮৫ মিনিটের জন্য কমলা মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। এই অল্প সময় কি তাঁর ওভাল অফিসে ঢোকার পথ খুলে দেবে?
কমলার সমস্যা অন্য জায়গায়। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চেয়ে তাঁর জনপ্রিয়তা কম। কয়েক মাস ধরে তাঁকে নিয়ে কিছু নেতিবাচক গল্পও শোনা যাচ্ছে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অভিবাসীর স্রোত বন্ধসহ বেশ কিছু ইস্যুতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু সীমান্তের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। ফলে নানা ইস্যুতে পরিস্থিতি তাঁর জন্য আরও খারাপ হয়ে গেছে।
তবে ভাইস প্রেসিডেন্টের সমর্থকেরা মনে করেন, নারী বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং নানা অপবাদ দিয়ে অন্যায়ভাবে তাঁকে হেয় করা হচ্ছে।
গ্যাভিন নিউসম

কমলা হ্যারিসের পর ক্যালিফোর্নিয়ার আরেক রাজনীতিককে নিয়ে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তিনি এই রাজ্যের গভর্নর গ্যাভিন নিউসম। তিনি ২০০৪ সালে সান ফ্রান্সিসকোর মেয়র নির্বাচিত হয়ে প্রথম সবার দৃষ্টি কাড়েন। তিনি রাজ্যের আইনকে লঙ্ঘন করে সমকামীদের বিয়ের বৈধতা দেন।
ওয়াইন ব্যবসায়ী নিউসম ২০১৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের গভর্নর নির্বাচিত হন। তিনি রক্ষণশীল ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে নিজেকে প্রগতিশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
করোনা মহামারির শুরু থেকে নিউসম একজন দৃঢ় মনোবলের নেতা হিসেবে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তবে নৈশভোজের একটি ভিডিও ফাঁস হয়ে গেলে বেকায়দায় পড়েন তিনি। করোনায় তাঁর প্রশাসনের আরোপিত বিধিনিষেধ তিনি নিজেই লঙ্ঘন করে ২০২১ সালে নৈশভোজের আয়োজন করেন। তবে সবকিছুর পরও রিপাবলিকান প্রার্থীকে হারিয়ে তিনি গত বছর দ্বিতীয় মেয়াদে গভর্নর নির্বাচিত হন।
ডেমোক্রেটিক পার্টির বড় অর্থদাতা হিসেবে নিউসমের একটা পরিচিত আছে। জাতীয় মঞ্চে কিছুদিন ধরে তাঁকে বেশ সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। রিপাবলিকান অধ্যুষিত ফ্লোরিডা ও টেক্সাসের মতো রাজ্যে নিজের দলের নানা নীতির সমালোচনা করে তিনি বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। তাঁর এমন বিজ্ঞাপন ভবিষ্যৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথাই বলে দিচ্ছে।
বার্নি স্যান্ডার্স

বয়সের কারণে যদি জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড় থেকে সরে যান, তাহলে ভারমন্টের সিনেটর ৮১ বছর বয়সী বার্নি স্যান্ডার্সকে নিয়ে যে কেউ সংশয় প্রকাশ করতেই পারেন। কারণ, ৮০ বছর বয়সে বাইডেন সরে দাঁড়ালে স্যান্ডার্স কোন দুঃখে ৮১ বছর বয়সে এই চ্যালেঞ্জ নেবেন।
তবে অনেক মার্কিন, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাট ভোটার এখনো মনে করেন, দীর্ঘদিনের এই বামপন্থী রাজনীতিক এবারও নির্বাচনের মাঠে থাকতে পারেন।
২০১৬ সালে দলীয় বাছাইপর্বে হিলারি ক্লিনটনের বিপক্ষে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত হেরে যান স্যান্ডার্স। ২০২২ সালেও তিনি বাইডেনের কাছে দলীয় বাছাইপর্বে হেরে যান। নিজেকে ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রবাদী’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া এই বর্ষীয়ান রাজনীতিক প্রশাসনের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রভাব রাখেন।
তবে স্যান্ডার্সের বার্তা হচ্ছে, তরুণ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর জন্য ডেমোক্র্যাটরা খুব কমই কাজ করেছেন। অথচ এই জনগোষ্ঠী সব সময় ডেমোক্র্যাটদের পাশে রয়েছে। তৃতীয়বারের মতো এবারও এই নেতা হোয়াইট হাউসের দৌড়ে শামিল হতে পারেন।
আরও যাঁদের নাম শোনা যায়
এর বাইরেও বাইডেনের অনুপস্থিতিতে বেশ কয়েকজনের নাম আসছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জে বি প্রিৎসকার, ফিল মারফি, অ্যামি ক্লোবুচার, এলিজাবেথ ওয়ারেন প্রমুখ।
হায়াত চেইন হোটেলের উত্তরাধিকার বিলিয়নিয়ার জে বি প্রিৎসকার সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, তিনি হতে পারেন ‘জরুরি সময়’-এর প্রার্থী। ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের গভর্নর হিসেবে তাঁর রয়েছে দারুণ রাজনৈতিক ও প্রগতিশীল রেকর্ড। তিনি একজন সহজাত রাজনীতিবিদ।
গোল্ডম্যান সাসের অন্যতম বিনিয়োগকারী এবং জার্মানিতে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফিল মারফি (৬৫) বর্তমানে নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের গভর্নর। ধারণা করা হয়, হোয়াইট হাউসের দিকে তাঁর দৃষ্টি রয়েছে। তবে তিনি বলে থাকেন, তিনি এক হাজার ভাগ বাইডেনের সমর্থক।
মিনেসোটার সিনেটর অ্যামি ক্লোবুচার (৬২) ২০২০ সালে শেষ মুহূর্তে দলীয় বাছাই থেকে সরে যান। তবে বাইডেন প্রশাসনে তিনি একজন প্রভাবশালী সিনেটের হিসেবে পরিচিত।

এলিজাবেথ ওয়ারেন (৭৩) ২০২০ সালের দলীয় বাছাই দৌড়ে ছিলেন। শুরুতে বেশ শক্তিশালী প্রার্থী মনে হলেও ধীরে ধীরে তিনি পেছনে পড়ে যান। ম্যাসাচুসেটসের এই সিনেটর নারীদের গর্ভপাত অধিকার আন্দোলনে বেশ সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন।
এ ছাড়া নিউ জার্সির কৃষ্ণাঙ্গ সিনেটর কোরি বুকার (৫৩), ইন্ডিয়ানার মেয়র পিট বুটিগিগ (৪১), মিশিগানের সাবেক গভর্নর গ্রেৎসেন হুইটমার, নিউইয়র্কের কংগ্রেস সদস্য আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেসের (২৫) নামও আসছে। তাঁদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ সিনেটর কোরি বুকার গত বছর এক আবেগময় বক্তৃতা দিয়ে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ান।

আছেন আরও দুজন
রাজনৈতিক বোদ্ধারা আরও দুজনকে এই তালিকা থেকে একেবারে বাদ দিতে চান না। তাঁরা হলেন সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। কেউ কি বলতে পারেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুবার ব্যর্থ হিলারি ক্লিনটন এবার থাকবেন না? ডেমোক্র্যাট ভোটারদের কাছে দুই নারীই বেশ জনপ্রিয়। অবশ্য জনপ্রিয়তা বাদ দিলে তাঁরা নিজেরা এখনো নির্বাচনী মাঠে নামার কোনো ইঙ্গিত দেননি। আবার বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে মিশেল ওবামার বক্তব্য শুনলে তাঁর অনুরাগীরা হতাশই হবেন। তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁকে জড়িয়ে প্রশ্ন করা হচ্ছে তাঁর সবচেয়ে অপছন্দের।







Add comment