Nazihar News Network
News from Nazihar It Solution Limited

ইরাকে আগে ছিলেন একজন সাদ্দাম, এখন অনেক

২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর আগ্রাসনে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন সরকারের পতন ঘটে। এই ঘটনায় ইরাকি নাগরিক আদেল আমের খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, সাদ্দামের পতনের মধ্য দিয়ে দুই দশকের অপশাসনের বুঝি অবসান হলো।

সাদ্দামের পতনের দিনটির কথা মনে করে আমের বলেন, ‘আমি পাগলের মতো নাচছিলাম। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে সাদ্দাম আর ক্ষমতায় নেই। আমার নিজেকে খাঁচা থেকে মুক্ত পাখি মনে হচ্ছিল।’

২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর আগ্রাসনে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন সরকারের পতন ঘটে। এই ঘটনায় ইরাকি নাগরিক আদেল আমের খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, সাদ্দামের পতনের মধ্য দিয়ে দুই দশকের অপশাসনের বুঝি অবসান হলো।

সাদ্দামের পতনের দিনটির কথা মনে করে আমের বলেন, ‘আমি পাগলের মতো নাচছিলাম। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে সাদ্দাম আর ক্ষমতায় নেই। আমার নিজেকে খাঁচা থেকে মুক্ত পাখি মনে হচ্ছিল।’

কিন্তু সাদ্দামের পতনের মধ্যে দিয়ে ইরাকে সংঘাত-বিশৃঙ্খলার আরেকটি যুগের সূচনা হয়। সাদ্দাম-পরবর্তী ইরাক বিচ্ছিন্নতাবাদ, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িক সংঘাতের উত্থান দেখে। এসব ঘটনা ৬৩ বছর বয়সী আমের ও তাঁর পরিবারের দুঃখ-কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

২০০৩ সালের ২০ মার্চ ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের আগ্রাসন শুরু হয়েছিল। এই আগ্রাসনের অনেক আগে থেকেই আমেরের দুর্ভোগ শুরু হয়েছিল।

গত শতকের আশির দশকে সাদ্দামের শাসনামলে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ইরাকি সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন আমের। এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সব সময় মৃত্যুর মুখোমুখি হতে আমি বিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি আমার বন্ধুদের ইরানের ভারী গোলার আঘাতে নিহত বা পঙ্গু হতে দেখেছি।’

আমের বলেন, ‘আমি তখন নিজেকে বলছিলাম, ইরাকি সেনাবাহিনী থেকে পালানোর সময় এসেছে। তবে আমি জানতাম, পালানোর পর ধরা পড়লে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। কিন্তু বেঁচে থাকাটাই সার্থক ছিল। আর আমি তা করেছি। এই কারণেই আজ আমি বেঁচে আছি।’

সেনাবাহিনী থেকে পালানোর পর নিজেকে রক্ষায় আমের বাড়ি ছাড়েন। তিনি পালিয়ে অন্যত্র চলে যান। শ্যালকের মালিকানাধীন একটি বাগানে থাকতে শুরু করেন তিনি। সাদ্দামের বাহিনী যাতে তাঁকে শনাক্ত করতে না পারে, সে জন্য তিনি দাড়ি রাখেন। ফেরারি জীবনে তিনি কৃষক হিসেবে কাজ করেছেন।

১৯৯০-৯১ সালে আরেকটি ঝুঁকি নিয়েছিলেন আমের। তখন ইরাকি বাহিনী প্রতিবেশী কুয়েতে আক্রমণ করে। সাদ্দামের এই পদক্ষেপ ইরাককে একটি বিচ্ছিন্ন দেশে পরিণত করে। এই আক্রমণের জেরে ইরাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় জাতিসংঘ।

সাদ্দামের জারি করা ডিক্রি সত্ত্বেও তখন আমের ইরাকি বাহিনীতে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। এ কারণে তাঁর সাবেক সহকর্মীসহ আশপাশের অনেক বাসিন্দা তাঁকে ঘৃণা করতেন। তবে তাঁরা কেউ তাঁকে ধরিয়ে দেননি। কারণ, তাঁরা জানতেন, ডিক্রি অমান্য করায় তাঁর মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।

আমের বলেন, তিনি সাদ্দামের শাসনামলে অনেক কষ্ট পেয়েছেন। এমনকি তিনি তাঁর জীবন শেষ করে দেওয়ার কথা পর্যন্ত ভেবেছিলেন।

২০০৩ সালে সাদ্দামের দীর্ঘ একনায়কত্বের অবসান হলে আমের খুশিতে তাঁর বাড়িতে একটি পার্টি দিয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, মার্কিন বাহিনী তাঁর দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় তাঁকে আর জীবন বাঁচানোর জন্য পালিয়ে বেড়াতে হবে না।

সাদ্দামের শাসনামলে বহু নিরপরাধ ইরাকি হত্যা-নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তাঁরা গণতান্ত্রিক অধিকার, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। সাদ্দাম সরকার বিলিয়ন বিলিয়ন পেট্রোডলার অপব্যয় করেছিল।

তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও তাঁর সামরিক জেনারেলরা ইরাকিদের একটি সমৃদ্ধ গণতন্ত্র ও অর্থনীতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু আরও সহিংসতা ইরাককে গ্রাস করে। ভয়ংকর জঙ্গি তৎপরতা শুরু হয় দেশটিতে। জঙ্গিদের বোমায় বহু মানুষ হতাহত হয়। তারা অনেক মানুষের শিরশ্ছেদ করে এক ভীতিকর পরিস্থিতির জন্ম দেয়। ২০০৬-০৮ সালে, বিশেষ করে ইরাকি সুন্নি ও শিয়ারা একটি রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে। এ সময় নদীতে অনেক লাশ ভাসতে দেখা যায়।

২০০৪ সালে আমেরের বাবা, এক ভাই ও এক স্বজনকে অপহরণ করে আল-কায়েদা-সংশ্লিষ্ট জঙ্গিরা। তাঁরা অপহৃত হওয়ার প্রায় এক বছর পর তাঁর বাড়িতে পুলিশ আসে। তারা তাঁকে বাগদাদের কেন্দ্রীয় মর্গে যেতে বলে। তিনি সেখানে গিয়ে তিনটি দেহাবশেষ দেখতে পান। হাতে থাকা ঘড়ি দেখে একটি লাশ চিনতে পারেন তিনি। লাশটি ছিল তাঁর ভাই কাদিমের। পরে তিনি লাশ তিনটি মর্গ থেকে নিয়ে এসে দাফন করেন।

আবার আত্মগোপনে চলে যান আমের। ২০১০ সালে তিনি একটি বিদেশি নির্মাণ কোম্পানিতে চাকরি পান। কিন্তু তিন বছরের মাথায় তাঁর জীবনে আবার বিপদ নেমে আসে। ইরান-সমর্থিত একটি মিলিশিয়া গোষ্ঠী তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। তাঁরা তাঁকে বেদম মারধর করে রাস্তার ধারে ফেলে দেয়। মারধরে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন।

আমের বলেন, মিলিশিয়ারা তাঁকে মার্কিন কোম্পানিতে কাজ করতে না করে দিয়েছিলেন। তারা বলেছিল, এই কাজ তাঁকে গুপ্তচরে পরিণত করবে।

দুঃখ করে আমের বলেন, তিনি অন্তত সাদ্দামের শাসনামলে পরিবারের সদস্যদের হারাননি। পরিবারের সদস্যদের হারানোর পর নির্যাতনেরও শিকার হলেন তিনি।মিলিশিয়াদের ভয়ে আমের চাকরিটি ছেড়ে দেন। ২০১৫ সালে তিনি দেশ ছাড়ার জন্য মনস্থির করেন। তুরস্ক থেকে গ্রিস হয়ে ইউরোপে যাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেন তিনি। এ জন্য তিনি জাল পাসপোর্ট বানান। যাত্রাকালে এথেন্স বিমানবন্দরে ধরা পড়েন তিনি। পুলিশ তাঁকে কারাগারে পাঠায়। পরে তাঁকে তুরস্কে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

তখন দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আমের বলেন, ‘ইরাকে থাকাটা আমার জন্য নরকের মতো হয়ে উঠেছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, জীবনের বিনিময়ে হলেও আমি দেশান্তরের চেষ্টা চালিয়ে যাব।’

২০১৬ সালে আবার গ্রিসে যাওয়ার চেষ্টাকালে তুর্কি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন আমের। তুর্কি কর্তৃপক্ষ তাঁকে ইরাকে ফিরতে বাধ্য করে। ইরাকে ফিরে আবার ভয়ের চক্রে পড়েন আমের। তাঁর আশঙ্কা, তিনি আবার নিশানা হতে পারেন। তাই তিনি এখনো ইরাক ছেড়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

দুর্বিষহ অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে আমের বলেন, ‘আমি সাদ্দামের শাসনামলে আত্মগোপনে ছিলাম। আর এখন আমি আবার আত্মগোপনে। আগ্রাসনের আগে এখানে (ইরাক) একজন সাদ্দাম ছিলেন। আজ আরও অনেক সাদ্দাম আছেন।’

Add comment

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.