দুই দশক আগেও শহরের অবস্থাপন্ন পরিবারে কেবল রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ থাকত। প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনদের কেউ কেউ সেই ফ্রিজে আবার ভাগ বসাতেন। এখন সময় বদলেছে। শহর থেকে প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ–সংযোগ। মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। আবার দেশীয় কোম্পানি ফ্রিজ উৎপাদন শুরু করায় পণ্যটির আকাশচুম্বী দামও কমেছে অনেকটা। ফলে শখের পরিবর্তে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে ফ্রিজ। সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্তের পাশাপাশি বর্তমানে নিম্ন আয়ের মানুষের ঘরেও জায়গা করে নিয়েছে রেফ্রিজারেটর।
কয়েক বছর ধরে গ্রীষ্মকাল এলেই শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বিক্রি বাড়ে। বর্তমানে সেটির সঙ্গে ফ্রিজও যুক্ত হয়েছে। এবার গরমের শুরুতেই বৈশাখ ও ঈদ পাশাপাশি হওয়ায় ফ্রিজের বিক্রি গত দুই-তিন মাসের তুলনায় বেড়েছে। তবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে গত এক বছরে ফ্রিজের দাম কোম্পানিভেদে ১০ থেকে ২২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। তা ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কিছুটা কমেছে। সে জন্য গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বিক্রি খুব বেশি না বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে ঈদের আগে সব প্রতিষ্ঠানই ক্রেতা টানতে মূল্যছাড়সহ বিভিন্ন অফার দিয়েছে।
একাধিক ফ্রিজ উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীরা এমন তথ্যই দিলেন। তাঁরা বলছেন, বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই ইলেকট্রনিকস পণ্যের বাজার বড় হচ্ছে। গত বছর ৩০ থেকে ৩২ লাখ ফ্রিজ বিক্রি হয়েছে। তার মধ্যে দেশীয় কোম্পানির হিস্যা ৮০ শতাংশের কাছাকাছি। তার মানে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ফ্রিজ দিয়েই অভ্যন্তরীণ চাহিদার বড় অংশ মিটছে।
দেশে রেফ্রিজারেটর উৎপাদনের প্রথম উদ্যোগ নেয় দেশীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন। তারপর একে একে যমুনা, মিনিস্টার, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, ট্রান্সকম ও ওরিয়ন কারখানা স্থাপন করে। বর্তমানে বিদেশি ব্র্যান্ড স্যামসাং, ওয়ার্লপুল ও কনকা কারখানা গড়ে উঠেছে দেশে।
দেশে ফ্রিজের বাজারের বড় অংশ ওয়ালটনের দখলে। ১৯৯৯ সালে চীন থেকে আমদানি করা টেলিভিশন বিক্রির মাধ্যমে ওয়ালটন ইলেকট্রনিকসের বাজারে যাত্রা শুরু করে। ২০০৫ সালের শেষ দিকে তারা গাজীপুরের কালিয়াকৈরে নিজস্ব জমিতে কারখানা নির্মাণ শুরু করে। বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০০৮ সালে, ফ্রিজ দিয়ে। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি কম্প্রেসর উৎপাদন শুরু করে। দেশের পাশাপাশি রপ্তানি বাজারে ভালো অবস্থান তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছর প্রতিষ্ঠানটি আড়াই লাখ ফ্রিজ রপ্তানি করেছে।
ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসির রেফ্রিজারেটর ইউনিটের প্রধান ব্যবসা কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ফ্রিজের বাজার প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে। তারপরও মার্চে ভালো বিক্রি হয়েছে। এবার ঈদের আগে বেচাবিক্রিও ভালো হচ্ছে।
তোফায়েল আহমেদ জানান, চলতি বছর সাত থেকে আটটি নতুন মডেলের ফ্রিজ বাজারে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে ওয়ালটন। ইতিমধ্যে সাইড বাই সাইড ডোর, বিগ মাল্টিমিডিয়া ডিসপ্লে, ওয়াটার ডিসপেনসার, ভার্টিক্যাল ফ্রিজার বাজারে এসেছে। বর্তমানে ৫০ লিটার থেকে ৬১৯ লিটার ফ্রিজ রয়েছে ওয়ালটনের। দাম ১২ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা পর্যন্ত।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ওয়ার্লপুল গত বছর ট্রান্সকম গ্রুপের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে নরসিংদীতে ফ্রিজ উৎপাদনের কারখানা করেছে। বর্তমানে ফ্রস্ট ও নন–ফ্রস্ট দুই ধরনের ফ্রিজই উৎপাদন করছে তারা। ট্রান্সকম ডিজিটালের বিক্রয়কেন্দ্র ছাড়াও বেস্ট ইলেকট্রনিকস, ভিশন এম্পোরিয়াম, এসকয়্যার ইলেকট্রনিকস ও র্যাংগস ইমার্টে ওয়ার্লপুলের ফ্রিজ পাওয়া যায়।
জানতে চাইলে ওয়ার্লপুল বাংলাদেশের হেড অব রিটেইল মার্কেটিং খন্দকার সালীম সা’দ স্বনন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের ক্রেতাদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে ২০০ থেকে ৩০০ লিটারের ফ্রস্ট ও নন–ফ্রস্ট ফ্রিজ বাজারে এনেছি। একই সঙ্গে ১৪ দিন শাকসবজি ও ফলমূল সতেজ এবং মাছ-মাংস ৩০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করার সুবিধাসংবলিত ফ্রিজও বাজারে রয়েছে আমাদের।’ ঈদ উপলক্ষে ফ্রিজের বেচাবিক্রি ভালো হচ্ছে বলে জানান তিনি।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ২০১৪ সালে রেফ্রিজারেটর ব্যবসায় নামে। নরসিংদীর ডাঙ্গায় তাদের কারখানায় বছরে ছয় লাখ ফ্রিজ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ভিশন ব্র্যান্ডের ফ্রিজ বিক্রি করছে। তাদের ৫০ লিটার ধারণক্ষমতার একটি ফ্রিজের দাম ১২ হাজার টাকা। আর ৫৬৬ লিটার ধারণক্ষমতার ফ্রিজের দাম ৯৯ হাজার ৯০০ টাকা।
জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর আমাদের ফ্রিজের ব্যবসা ৪০ শতাংশ বেড়েছে। আমরা ইনর্ভাটার কম্প্রেসারের ফ্রিজ নিয়ে এসেছি। এতে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে।’ ২০২১ সালের মার্চে প্রকাশিত মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশের (এমডব্লিউবি) এক গবেষণায় বলা হয়, দেশে তিন ধরনের ফ্রিজ বিক্রি হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফ্রস্ট ফ্রিজের বাজার হিস্যা ৮৫ শতাংশের কাছাকাছি। নন–ফ্রস্ট ৮ দশমিক ৩৩ ও চেস্ট বা ডিপ ফ্রিজ ৬ দশমিক ৭ শতাংশের মতো বিক্রি হয়।
ইলেক্ট্রা ও স্যামসাং ফ্রিজের বাজারজাতের সঙ্গে যুক্ত ইলেক্ট্রা ইন্টারন্যাশনালের মহাব্যবস্থাপক (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) মো. মোবারক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে আমরা ১০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় দিচ্ছি। ইলেক্ট্রা ব্র্যান্ডের ৭১ থেকে ৫৬৩ লিটার ধারণক্ষমতার ফ্রিজের দাম ১৫ হাজার ৯০০ টাকা থেকে ৯৯ হাজার ৯৯০ টাকা। আর স্যামসাংয়ের ২১৮ লিটার থেকে ৮৪৫ লিটারের ফ্রিজের দাম ৪৪ হাজার ৯০০ টাকা থেকে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৯০০ টাকা।’







Add comment